ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুরস্কের অনুরোধে নিরাপদে গাজা ছাড়ল ইসমাইল হানিয়ার পরিবার

তুরস্কের অনুরোধে নিরাপদে গাজা ছাড়ল ইসমাইল হানিয়ার পরিবার

চলতি মাসের শুরুতে অন্তত ৬৬ ফিলিস্তিনি ও তুর্কি নাগরিককে নিরাপদে গাজা ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। মূলত আঙ্কারার কাছ থেকে আসা অনুরোধেই এই উদ্যোগ নেয় তেল আবিব। গত সোমবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানায়, ওই ৬৬ জনের মধ্যে তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হামাস নেতা ও সাবেক রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান ইসমাইল হানিয়ার পরিবারের ১৬ সদস্যও আছেন। দুইটি আলাদা সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল-তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় ১৪ তুর্কি নাগরিক ও তাদের ৪০ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে (স্বামী-স্ত্রী, পুত্র, মা ও বাবা) মুক্তি দেওয়া হয়।

চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তি মেনে যুদ্ধে বিরতি দিতে সম্মতি দেয় হামাস ও ইসরায়েল। হামাসকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তুরস্ক।

জানা গেছে, ইসমাইল হানিয়া পরিবারের ১৬ জনের মধ্যে পাঁচ জনের সঙ্গে তুরস্কের নাগরিকদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক বিষয়গুলোর দেখভাল করতেন ইসমাইল হানিয়া। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হানিয়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুরস্কের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তুরস্কে হামাসের আনুষ্ঠানিক কার্যালয় না থাকলেও সংগঠনের নেতারা নিয়মিত কাতার, তুরস্ক, মিসর ও লেবাননে যাতায়াত করে থাকেন। অনেক সময় তারা তুরস্কে মাসের পর মাসও অতিবাহিত করেন।

যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তুরস্ক হানিয়াসহ একাধিক হামাস নেতাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে।

ইসরায়েলের ‘বিস্ময়কর’ সিদ্ধান্ত : বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল হানিয়ার পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে গাজা ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, যা ‘বিস্ময়কর’। বিশেষত, আইডিএফের হাতে হানিয়ার তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি নিহতের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে হানিয়ার পরিবারের ওই সদস্যরা গাড়িতে থাকা অবস্থায় হামলার শিকার হন। একই সময় ইসরায়েল হানিয়ার বোন সাবাহ আল-সালেম হানিয়াকেও গ্রেপ্তার করে। তিনি ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তেল শেভায় বসবাস করছিলেন।

এরদোয়ান-নেতানিয়াহুর সম্পর্কের বরফ গলানোর উদ্যোগ? : ইসরায়েল সরকার-সংশ্লিষ্ট সূত্ররা জানান, এই সিদ্ধান্ত আঙ্কারার সঙ্গে তেল আবিবের কূটনীতিক বরফ গলানোর উদ্যোগের অংশ। গাজায় যুদ্ধবিরতি চালুর পর থেকেই ইসরায়েলের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, তুরস্কের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ‘উষ্ণতা’ বাড়ানোর আগ্রহ দেখাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের ডানপন্থি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান ইব্রাহিম কালিনের প্রশংসা করে জানায়, তিনি ‘(হামাসের হাতে বন্দি থাকা) জিম্মিদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন’ এবং ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের’ উদ্যোগ নিয়েছেন। ইসরায়েলি সাংবাদিক বেন কাসপিত এ মাসের শুরুতে মারিভ সংবাদমাধ্যমে বলেন, ইসরায়েল ‘ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছে।’

‘তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইসরায়েলের কট্টর সমালোচক হলেও, তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হাকান ফিদানকে ইসরায়েল আরও বাস্তববাদী মনে করে,’ যোগ করেন তিনি। গত রোববার মারিভে প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে ইসরায়েলি চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট উরিয়েল লিন যুক্তি দেন, ইসরায়েলের উচিৎ আগ বাড়িয়ে এরদোয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তার মতে, ‘গাজার ভবিষ্যৎ চাবিকাঠি তুরস্কের হাতে।’ তিনি বলেন, ‘তুরস্ক ইসরায়েলের শত্রু নয়। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন বাণিজ্য, অর্থনীতি ও পর্যটন নিয়ে ফলপ্রসূ সম্পর্ক ছিল।’ তিনি মন্তব্য করেন, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রনীতি কতিপয় কট্টর মন্ত্রীদের ‘শিশুসুলভ আচরণ ও দাবিতে’ প্রভাবিত হওয়া উচিৎ নয়।

এ বিষয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ধৈর্যশীল মনোভাবের প্রশংসা করেন উরিয়েল। ‘আমাদের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পরিবেশকে স্থিতিশীল করা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে সামনে এগিয়ে রাখায় তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো খুবই জরুরি,’ বলেন তিনি।

নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধবিরতি নস্যাৎ করে দিতে পারেন, আশঙ্কা হোয়াইট হাউসের : গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে চলছে যুদ্ধবিরতি। কিন্তু, হোয়াইট হাউস আশঙ্কা করছে যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এটি নস্যাৎ করে দিতে পারেন। গতকাল মঙ্গলবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে যে তারা নেতানিয়াহুর ভূমিকা নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন।

সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, নেতানিয়াহু যাতে গাজা যুদ্ধবিরতি নষ্ট করতে না পারেন তাই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ ইউটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনারকে আজ মঙ্গলবার ইসরায়েলে পাঠানো হচ্ছে। এই মার্কিন কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধে নেতানিয়াহুকে চাপ দেবেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তারা নেতানিয়াহুকে গাজা হামলা থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। হারেৎজের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়- মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় এ কথা বলা হয়েছে যে, মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রী ও উগ্র ডানপন্থি নেতা বেজালেল স্মৎরিচকে ‘ট্রাম্পের ঐতিহাসিক গাজা চুক্তিকে পুরোপুরি মেনে নেওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের বরাত দিয়ে অপর ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা ক্রমাগত আশঙ্কা করছেন যে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামাসের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধে নেমে পড়তে পারেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশ না করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নেতানিয়াহু শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে এতটাই সক্রিয় যে তাকে নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের আশঙ্কা অনেক বেড়েছে। তিনি যেন গাজা শান্তিচুক্তি অকার্যকর করে দিতে না পারেন সে জন্য শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাদের ইসরায়েলে পাঠানো হচ্ছে।

কানাডায় এলে নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করা হবে- মার্ক কার্নি : গত সোমবার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের দেশগুলোর পর এবার উত্তর আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী দেশ কানাডা যুদ্ধাপরাধী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শুক্রবার প্রচারিত ব্লুমবার্গ পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি জানান, তিনি নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নেতানিয়াহু কানাডায় এলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান তিনি। এতে আরও বলা হয়, নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করা হবে কী না?- কার্নিকে এমন প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ’। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। কার্নি আরও বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াটা তার অগ্রাধিকার ছিল। কিন্তু, এটাই শেষ নয়। ‘ইসরায়েলের পাশে শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে স্বাধীনভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র থাকবে,’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

১৯৪৭ সাল থেকে কানাডা দুই রাষ্ট্র সমাধানের নীতি মেনে চলছে উল্লেখ করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ফিলিস্তিনকে এখন স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ নেতানিয়াহুর সরকার জাতিসংঘের নীতিমালা লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনা নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। ১৯৪৭ সাল থেকে কানাডার মেনে চলা সরকারি নীতির বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছে।’

কার্নির এমন বক্তব্যের পর নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক পরামর্শক ওফির ফাল্ক কানাডীয় সংবাদমাধ্যমে বলেন, কানাডা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০ দফা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করায় মার্ক কার্নির উচিত বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে তার দেশে স্বাগত জানানো।

গত দুই বছর ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশ শিশু ও নারী। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আদালতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। পরে আদালতের রায়ে ইসরায়েলি নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কানাডার আগে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, স্লোভেনিয়া ও সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত