আমের মুকুলের ভাঁজে ভাঁজে কৃষকের সোনালি স্বপ্নের হাতছানি। আমের মুকুলে স্বপ্ন বুনছেন রংপুর অঞ্চলের চাষিরা। রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় প্রায় ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৮৩৫ টন আমের। চলতি বছর গাছে গাছে ফুটেছে আমের মুকুল। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে চাষিদের মনও চাঙা হয়ে উঠছে। মৌসুমের শুরুতেই কুয়াশা থাকলেও এখন প্রকৃতি বেশ অনুকূলে। ডালে ডালে ভরা আমের মুকুলে স্বপ্ন বুনছেন রংপুরের চাষিরা। গত কয়েক বছরে আম চাষে বদলে গেছে রংপুরের চাষিদের জীবনমান। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ আর মৌমাছির গুনগুন শব্দে শুভাসিত ও মুখরিত গোটা অঞ্চল। মুকুলের ভাঁজে ভাঁজে প্রোথিত রয়েছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন।
কয়েক দিন পর মুকুলের পেট চিড়ে বের হবে আমের দানা। এ দানা শুধু দানাই নয়, এ হলো কৃষকের আগামীর (দিনের) স্বপ্ন। আগামীর সোনালি স্বপ্নে আম চাষিরা বিভোর।
সরেজমিন রংপুর সদরের পালিচড়া, শ্যামপুর, লাহেড়ীরহাট, মিঠাপুকুরের গোপালপুর, পদাগঞ্জ, পাইকারেরহাট, রূপসি, মৌলভীবাজার, সর্দারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে ফুটেছে মুকুল, যা ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। সেই ঘ্র্রাণে চাষিদের মনও চাঙা। মৌসুমের শুরুতেই কুয়াশা থাকলেও এখন প্রকৃতিও বেশ অনুকূলে। এবার ডালে ডালে ভরা আমের মুকুলে ভালো ফলনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় চাষিরা স্প্রে, গাছের গোড়ায় পানি দেয়া, পানি ছিটানোসহ মুকুল আটকাতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের যত্ন নেয়া শুরু করেছেন। ব্যবসায়ীদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে। বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়া ইউপির কাঁচা বাড়ি নয়াপাড়া গ্রামের আম চাষি শাহাবুল ইসলাম জানান, আমার আম বাগানে পর্যাপ্ত মুকুল এসেছে। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হয় তাহলে কয়েক লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারব। বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা আফরোজ বলেন, বদরগঞ্জ উপজেলা ৫৫৮ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আমের বাম্পার ফলনের সম্ভবনা রয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সময়ের আগেই কিছু গাছে মুকুল আসছে। হাঁড়িভাঙ্গাসহ অন্যান্য আমের মুকুল এবার আগাম হয়েছে। তাতে তেমন কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় ৬ হাজার ১৮৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৮৭৪ মেট্রিক টন আম। তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এবার এই অঞ্চলে প্রায় ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন আমের। তবে হাঁড়িভাঙ্গার উৎপত্তিস্থল রংপুরে গত বছর ১ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গার চাষ হয়েছিল। এবছর তার চেয়ে বেশি হবে বলে আশা কৃষি বিভাগের। চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙ্গা আমের একটি রীতি আছে। এক বছর বেশি ফলন হয় তো পরের বছর কম হয় এটাই স্বাভাবিক। দাম কম পাওয়ায় প্রতি বছরই ব্যবসায়ীদের কাছে আমের বাগান আগাম বিক্রি করতে হয় বলে জানান তারা। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও হিমাগারের ব্যবস্থা হলে তারা আম বিক্রি করে লাভবান হবেন। মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ, পদাগঞ্জ, রানীপুকুরসহ বিভিন্ন এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চাষি অভিযোগ করেন, আমচাষিদের সঠিক পরামর্শ দেয়ার মতো মনোভাব কৃষি বিভাগের নেই এবং সব ধরনের প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত তারা। সরকারি প্রণোদনাগুলোর সঠিক বণ্টন হলে আমচাষিরা আরও উপকৃত হতো ও নতুন নতুন চাষি বাড়ত।
মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ এলাকার চাষি নুর হোসেন বলেন, আমের মুকুল এবার ভালোই আছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে। একই উপজেলার এলাহিমোড় চকবাজার এলাকার হামিদুর রহমান বলেন, পদাগঞ্জ অঞ্চল হাঁড়িভাঙ্গাসহ আমের জন্য বিখ্যাত। সঠিক দাম পেলে চাষিরা আরও লাভবান হবেন। তবে লোকসান নেই।
রানীপুকুর এলাকার মিনজারুল ইসলাম বলেন, এবার আমের ভালো মুকুল এসেছে। গত বছরের চেয়ে বেশি। সঠিক পরিচর্যা করলে ভালো ফলন হবে। আশা করছি আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে লাভবান হবেন।
সদরের আম ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, আগাম বাগান নিয়ে রেখেছি ভালো লাভের আশায়। লাভের আশা থাকলেও ফলন নিয়ে সন্দিহান।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন রংপুর জেলার ৮ উপজেলায় আম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৩৪৫ হেক্টর জমির মধ্যে হাঁড়িভাঙ্গা আম ১৯১০ হেক্টর জমিতে চাষ করছে। এবছর যে আবহাওয়া পরিষ্কার, বৃষ্টি-কুয়াশা নেই, ঝড় বাতাস নেই, সেই হিসেবে কৃষি বিভাগ আশা রাখছে চাষিরা যদি ভালো করে পরিচর্যা করে তাহলে মুকুল-পরবর্তী যে ফল সেটি আশানুরূপ ফলন হবে। তিনি আরো বলেন, আমের এলাকা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের নানা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ মো. আফজাল হোসেন বলেন, রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় ৬১৮৯ হেক্টর জমিতে আমের চাষ করা হবে। এ অঞ্চলে জনপ্রিয় হাঁড়িভাঙা আমসহ অন্যান্য আমের মুকুলে ছেয়ে গেছে। এরইমধ্যে হাঁড়িভাঙ্গা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এজন্য দেশে-বিদেশে এই আমের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন রংপুর কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলার মধ্যে রংপুর জেলাতেই আম চাষ বেশি হয়। কারণ হিসেবে বলেন, রংপুর জেলার জনপ্রিয় হাঁড়িভাঙা আম।