ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সাগরতলে আলো জ্বলে

হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
সাগরতলে আলো জ্বলে

পৃথিবীতে অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর অভাব নেই। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী কেমন পরিবেশে বসবাস করে, তার ওপর ভিত্তি করে এদের নানা রকম শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। মূলত একটি পরিবেশে প্রাণীদের নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এসব প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই এদের মাঝে এসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। এভাবেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রাণীজগতে বিবর্তন ঘটে আসছে। পৃথিবীতে শতকরা প্রায় ৭৬ ভাগ সামুদ্রিক প্রাণীই বায়োলুমিনিসেন্ট। এরা শরীর থেকে প্রধানত দুই উপায়ে উজ্জ্বল আলো তৈরি করতে পারে। যথা- দেহের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পরিবর্তন ও শরীরে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়ার কারণে। সমুদ্র ছাড়া স্থলেও এমন অনেক প্রাণী রয়েছে। জোনাকি পোকা এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এরা ছাড়াও বিশেষ কিছু প্রজাতির গুবরে পোকার বায়োলুমিনিসেন্স রয়েছে। এমনই কিছু বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণী ও এদের এ ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে অবাক করা কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-

অ্যাংলারফিশ : সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী এক অদ্ভুত মাছ হলো অ্যাংলারফিশ। শরীরের তুলনায় অনেক বড় এদের চোয়াল। সেই চোয়াল করাতের মতো ধারালো দাঁত দিয়ে বেষ্টিত। তবে এ মাছটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হলো, এর মাথার অগ্রভাগে অ্যান্টেনার মতো এক প্রবৃদ্ধি। এ অ্যান্টেনার শেষাংশে স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের মতো আলো জ্বলে। ফাইটোপ্ল্যাংকটন নামক একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে অ্যাংলারফিশ এ আলো তৈরি করে। সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ২ হাজার মিটার গভীরে এ মাছগুলো বিচরণ করে থাকে। এদের আলো তৈরির পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো শিকার করা। সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার পরিবেশে আলো জ্বালিয়ে এরা শিকারকে আকৃষ্ট করে। এ কারণেই তাদের আলো তৈরির অঙ্গটিকে ‘লিউর’ নাম দেওয়া হয়েছে। এ লিউর নাড়িয়ে অ্যাংলারফিশ শিকারকে ধীরে ধীরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে আসে। তারপর কিছু বোঝার আগেই শিকার এ মাছের পেটে সাবাড় হয়ে যায়। স্ত্রী অ্যাংলারফিশ পুরুষদের তুলনায় আকারে অনেক বড় হয়। এরা প্রজনন মৌসুমে প্রায় হাজার খানেক ডিম দেয়। এ অদ্ভুত প্রকৃতির মাছের বয়সসীমা ১০ থেকে ১৫ বছর। মাছগুলো প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে দেখতে পাওয়া যায়।

স্কুইড : সমুদ্রে যত অদ্ভুত প্রকৃতির প্রাণী বাস করে, তাদের মাঝে স্কুইড একটি জনপ্রিয় নাম। বহু প্রজাতির স্কুইডের আলো তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এরা শিকার ধরার জন্য এ আলো তৈরি করে না; বরং এ আলো তারা তৈরি করে শিকার থেকে বাঁচার জন্য। স্কুইডের দেহে আলো তৈরির মূল উৎস হলো কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া। এ ব্যাকটেরিয়া ও স্কুইড হলো মিথোজীবি। অর্থাৎ এরা একে অপরকে সাহায্যের মাধ্যমে একত্রে বেঁচে থাকে। স্কুইড এ ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খাদ্য হিসেবে অ্যামিনো এসিড ও শর্করার জোগান দেয়। বদৌলতে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের বায়োলুমিনিসেন্স ক্ষমতা দিয়ে স্কুইডদের শত্রু থেকে রক্ষা করে। কিছু প্রজাতির স্কুইড শিকারি প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য উজ্জ্বল তরল মিউকাস দেহ থেকে নিঃসৃত করে। এভাবে এরা শিকারিকে দ্বিধায় ফেলে পালিয়ে যায়। আবার কিছু স্কুইড রয়েছে, যেগুলো নিজেদের স্বচ্ছ শরীরকে উজ্জ্বল করার মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। এ ধরনের একটি স্কুইড হলো ববটেইল স্কুইড। ববটেইল স্কুইড ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে নিজের দেহ প্রজ্বলিত করে। এদের শরীর অনেক স্বচ্ছ হওয়ায় এরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। এ কারণে শিকারি প্রাণীগুলো সহজে এদের ধরতে পারে না।

ল্যান্টার্ন ফিশ : ল্যান্টার্ন ফিশ অ্যাংলার ফিশের ন্যায় গভীর সমুদ্রের মাছ। এদের মাথায় ফটোফোর নামক এক বিশেষ অঙ্গ থাকে। যেখান থেকে আলো সৃষ্টি হয়। এ আলো সৃষ্টির প্রক্রিয়া অনেকটা জোনাকির মতো। লেন্স আকৃতির ফটোফোর ব্যবহার করে এরা ইচ্ছামতো আলোর উজ্জ্বলতা পরিবর্তন করতে পারে। এভাবে এগুলো যেমন সমগোত্রীয় অন্যান্য মাছের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তেমনই শিকার ও প্রজননের উদ্দেশ্যে এ আলো কাজে লাগায়।

ক্রিস্টাল জেলি : সামুদ্রিক প্রাণীদের মাঝে অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রাণী হলো জেলিফিশ। জেলিফিশদের মাঝে আবার অন্যতম সৌন্দর্যের অধিকারী হলো একটি বিশেষ প্রজাতি। এদের নাম ক্রিস্টাল জেলি। একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ দেহবিশিষ্ট এ জেলিফিশগুলো আলো তৈরি করতে পারে। এদের কর্ষিকা থেকে সবুজাভ নীলবর্ণের আলো নির্গত হয়। তবে এদের আলো তৈরির পেছনে তেমন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। এরা এদের আঠালো কর্ষিকা দিয়ে শিকার আকড়ে ধরে এবং নিজেদের দেহের প্রায় অর্ধেক আকৃতির শিকার খেতে পারে। ২০০৮ সালে একদল বিজ্ঞানী ক্রিস্টাল জেলির দেহ থেকে এক উপকারী প্রোটিন আবিষ্কার করেন। একই বছর এ আবিষ্কারের জন্য তারা নোবেল পুরষ্কার পান।

ক্লাস্টারউইংক শামুক : কিছুতে স্পর্শ করলে বা কোনো বিপদে পড়লে এরা খোলসে ঢুকে পড়ে। এ খোলস থেকে এরা টিপ টিপ করে আলো জ্বালায়। শামুকের এ আলোর উৎস হলো বায়োলুমিনিসেন্ট ব্যাকটেরিয়া।

মুন জেলিফিশ : মুন জেলিফিশ হলো আরেক প্রজাতির জেলিফিশ, যেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আলো তৈরি করে। এদের দেহে লুসিফেরিন নামক পদার্থ থাকে, যা পানির অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে লুসিফেরেজ এনজাইম তৈরি করে। এদের দেহের শতকরা ৯৫ ভাগই পানি। মুন জেলিফিশ মূলত প্ল্যাংকটন, মাছের ডিম ও ছোট ছোট চিংড়ি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এদের বয়সসীমা ছয় মাস। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এরা মারা যায়।

মটিক্সিয়া : মটিক্সিয়া মূলত কেন্নো। কেন্নোদের মাঝে এক বিশেষ প্রজাতি হলো মটিক্সিয়া সিকুওয়ি। এ প্রজাতির কেন্নো দেহ থেকে নীলাভণ্ডসবুজ বর্ণের আলো তৈরি করতে পারে। এদের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। ৩-৪ সেন্টিমিটার লম্বা এ প্রাণীর দেহ মোট ২০টি খণ্ডে বিভক্ত। তা ছাড়া এদের শরীর বিষাক্ত সায়ানাইড তৈরি করতে পারে। স্ত্রী কেন্নো পুরুষ কেন্নো থেকে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। জ্বলজ্বল করতে থাকা এ কেন্নো যে কোনো নিশাচর প্রাণীর জন্য সাক্ষাৎ যম। এদের দেহ থেকে নির্গত বিষ একটি সুস্থ প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে। তবে গর্তে বসবাসকারী এ কেন্নোর দৃষ্টিশক্তি থাকে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত