প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্র হলো পৃথিবী; পৃথিবীর মূল সম্পদ হলো ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। আর পরিবেশ-বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ। বৃক্ষ আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আমাদের বেঁচে থাকার প্রায় প্রতিটি উপাদান আমরা উদ্ভিদ বা বৃক্ষ থেকে পেয়ে থাকি। যেহেতু একটি প্রাণীর টিকে থাকার জন্য উদ্ভিদ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে তাই ইসলামেও এর গুরুত্ব অনেক। ইসলাম প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করেছে। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। পরিবেশ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা থেকে ভক্ষণ করে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৩)।
আমাদের চারপাশের গাছপালা, নদীনালা, খালবিল, পাহাড়পর্বত, ইত্যাদি সবই আমাদের প্রকৃতি। মহান আল্লাহ তায়ালার এ এক অপার নেয়ামত। এর যেকোনো একটা উপাদন না থাকলে পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যেতো। মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি বস্তুকে ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন যেভাবে আমাদের দরকার। কোন ধরনের পরিবেশে বাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে ঠিক সেভাবেই পরিবেশকে সাজিয়েছেন। আমাদের প্রতিটি চাহিদা সঠিক সময়ে পূরণের জন্য তিনি পরিবেশকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি ও এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিকল্পিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই, বস্তুত এর ভা-ার তোমাদের কাছে নেই।’ (সুরা হিজর : ১৯-২২)।
বায়ুম-লের ভারসাম্য বজায় রাখতে ও জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় আল্লাহতায়ালা বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন করেছি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা কাফ : ৭-৮)।
মহান আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন এবং যেই অঞ্চল তিনি যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেই অঞ্চলের মানুষ ও প্রাণীর চাহিদাও সেই অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠিক করেছেন। তাই দেখা যায়, শীতপ্রধান যেসব অঞ্চলে বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে মাঠ, ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও শীতের শেষে প্রাকৃতিক উদ্ভিদকুল সবুজেরা হেসে ওঠে। বরফাচ্ছাদিত মৎস্যকুল স্বাভাবিক জীবন পরিচালনের মাধ্যমে স্রষ্টার অপার মহিমার জানান দেয়।
আমরা মানুষ বড়ই নির্বোধ। আমরা পরিবেশের প্রয়োজন উপলব্ধি করতে চাই না। আমরা নিজেদের অতিরিক্ত বা অহেতুক সুখের ও সমৃদ্ধির আশায় প্রতিনিয়ত পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলছি। আমাদের অপরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা ও অমানবিক কর্মকা-ের কারণে প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। আমরা অযথা কলকারখানা তৈরি করে, অযথা গাছ কেটে পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা শেষ করে ফেলছি। ফলে বায়ুতে দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, রোগবালাই ও প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। যার ফলে আমাদের বাংলাদেশের মতো নাব্য এলাকায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। তাই এসব বিপর্যয় থেকে আমাদের বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বনরক্ষা ও বৃক্ষরোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
মহানবী (সা.) চৌদ্দশ বছর আগেই বৃক্ষরোপণ বা বনরক্ষার তাগিদ দিয়েছেন। গাছ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করে তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। এক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিঁড়লে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’ নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৫২৪১, বায়হাকি : ৬/১৪০)।
পরিবেশের সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইসলামে রয়েছে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা; যা অনুসরণ করলে বিশ্বব্যাপী একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে প্রাকৃতিক-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান। তখন তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা রুম : ৪৮)।
গাছপালা, লতাপাতা, মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে ও মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে; আর এরপর তা থেকে মানুষ, পাখি বা কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকা।’ (মুসলিম : ৫৫৩২)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি লাগাবে।’ (মুসলিম : ৫৫৬০)।
সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য চাই সুস্থ ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুকূল ও সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব দীর্ঘায়িত হতে পারে না। বনভূমি ও পশুপাখি আল্লাহ তায়ালার অকৃত্রিম দান ও প্রকৃতির অনিন্দ্য শোভাবর্ধক। তাই রাসুল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ভীষণ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। এ জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দাবিতে পৃথিবীতে সম্মিলিত রব উঠেছে। কিন্তু কিছু মানুষের অদূরদর্শিতা ও অমানবিক কর্মকা-ের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সুরা আর রুম : ৪১)।
একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত, প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টিকে প্রতিনিয়ত সেবা দানে ব্যস্ত। এ জন্য পরিবেশ ধ্বংসের যেকোনো উদ্যোগ নিশ্চিতরূপে একটি জঘন্যতম কুকর্ম এবং এই কাজ মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালার দেওয়া সেবা থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর। তাই একজন বিবেকবান মোমিন কখনও পরিবেশকে এবং এর গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারে না। নিজের সামান্য চাহিদার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করতে পারে না। অতএব এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, বিনা প্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে সৃষ্টিকে কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত না করাই একজন প্রকৃত মোমিনের পরিচায়ক। মহান আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এর নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের নিজেদের নিয়োজিত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখিকা : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা