ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন হারাম

ইসলামে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন হারাম

স্রষ্টা কর্তৃক বান্দার জন্য মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হলো ইসলাম। ইসলাম কোনো ছেলেখেলা ধর্ম নয় যে, কিছু মানলাম কিছু এড়িয়ে গেলাম বরং সম্পূর্ণ মানাই ইসলাম। ইসলামে মানব জীবনের সব রীতিনীতি নির্ধারিত ও সুস্পষ্ট। সুরা আশ-শূরার ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন।’ সুরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।’ আফসোস যে, ইসলামে সব কিছু নির্ধারিত থাকলেও বর্তমান মুসলিম সমাজ আধুনিকতার কবলে অপসংস্কৃতিকে ধারণ করছে। যার অন্যতম উদাহরণ হলো ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ বা নববর্ষ উদযাপন। এটা স্পষ্টতই ইসলামি রীতিবিরোধী। আমরা বর্তমান মুসলিম সমাজ ইসলামি সংস্কৃতির পাশাপাশি বিধর্মী সংস্কৃতি লালনের মধ্য দিয়ে মিশ্র জাতিতে রূপ নিয়েছি।

থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করে আমরা যাদরেকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছি, তারা প্রকৃতপক্ষে আমাদের শত্রু। তারা কখনও আমাদের বন্ধু হবে না, যে যাবৎ আমরা আমাদের দ্বীন ত্যাগ করে তাদের ধর্মের অনুসরণ না করি। তারা আমাদের দ্বীন ও নবীকে নিয়ে উপহাস করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। যারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও খেল তামাশারূপে গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে থেকে তোমাদের আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে ও কাফেরদের। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যদি তোমরা মোমিন হয়ে থাকো।’ সুরা মায়েদার ৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, ‘হে মোমিনরা! ইহুদি ও নাসারাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সে নিশ্চয়ই তাদের একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম কাওমকে হিদায়াত দেন না।’ অতএব বিধর্মীদের উৎসবে যোগ দেওয়া, তাদের সমর্থন জানানো কিংবা সহায়তা করা মানে নিজদের দ্বীনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

আমরা মুসলমানরা অনেকেই ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ তথা নববর্ষের উৎপত্তি জানি না। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষের প্রচলন ঘটায়। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যবিলনিয়ায় শুরু হতো ২০ মার্চ মহাবিষুবের দিনে। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ। তবে ১ জানুয়ারি নববর্ষের দিন নির্ধারিত হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো কালেই মুসলমানদের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের কোনো নজির নেই।

কাফের, মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টানদের পালনকৃত উৎসব ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ বা নববর্ষ উদযাপন করা হারাম। কেননা এগুলো উদযাপন করা রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত নয়। যেসব বিষয় রাসুল (সা.) থেকে প্রমাণিত নয়, সেসব বিষয় মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত নয়। কারণ বিধর্মীয় উৎসব অনুসরণ মুসলিমদের জন্য হারাম। নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ : ৩৫১৪)। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, ‘রাসুল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা গ্রহণ কর এবং যা দেননি, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ (সুরা হাশর : ০৭)।

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কিতাব, রাসুলের সুন্নাহ, খোলাফায়ে রাশেদার আদর্শ ও সব আলেম একমত যে, মুশরিকদের শিরকি কাজের বিরোধিতা করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না।’

হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন হজরত ওমর (রা.) রাসুলের (সা.) কাছে এসে বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমরা ইহুদিদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি, যাতে আমরা আশ্চর্যবোধ করি, এর কিছু আমরা লিখে রাখব কি? রাসুল (সা.) বললেন, তোমরাও কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছ? যে রকম ইহুদি নাসারারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। অবশ্যই আমি তোমাদের কাছে পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিষ্কার ধর্ম নিয়ে এসেছি। নবী মুসা (আ.) যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে তাকেও আমার অনুসরণ করতে হতো। (মুসনাদে আহমদ, বাইহাকি, মিশকাত)।

রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনাবাসীদের দুটি আনন্দের দিন ছিল, যেখানে তারা খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগ করত। রাসুল বললেন, এই দুটি দিন কী? তারা বললেন, আমরা আনন্দ ও খেলাধুলা করতাম। রাসুল (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তার পরিবর্তে তার চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন : ঈদুল ফিতর ও ইদুল আজহা।’ (আবু দাউদ ও আহমাদ)। ওই হাদিস প্রমাণ করে, কাফেরদের উৎসব পালন করা হারাম। কারণ নবী (সা.) আনসারদের জাহেলি উৎসবের ওপর বহাল রাখেননি। তাই মুসলমানদের সুরা কাফিরুনের আয়াতের ওপর অটল থাকতে হবে। আয়াতের সারাংশ এমন, ‘বলুন! তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য আমার দ্বীন আমার জন্য।’

আজ নববর্ষ উৎসবের নামে অশ্লীলতার প্রসার হচ্ছে। বেহায়াপনার সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বেহায়াপনা ও অপরাধ একসূত্রে গাঁথা। ক্ষেত্র বিশেষ স্বাভাবিক অপরাধ থেকে বেহায়াপনা তথা অশ্লীলতা বেশি ক্ষতিকর। কারণ একবার তরুণ-তরুণীদের অশ্লীলতায় লিপ্ত হলে তা থেকে বেরুতে পারে না। ফলে বারবার একই অপরাধে নিপতিত হতে থাকে। কাজেই প্রতিটি মুসলিম পরিবারে নিজে, পরিজন ও সন্তানদেরকে অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা জরুরি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করো এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যার ওপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফেরেশতারা, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ দেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হন না। আর তাদের যা নির্দেশ দেওয়া হয় তাই তামিল হয়।’ (সুরা আত-তাহরিম : ০৬)।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। তারা হলেন, মাদকাসক্ত, পিতামাতার অবাধ্য ও দাইউস, যে তার পরিবারে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়। (মুসনাদে আহমদ-৬৯)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতাকে তার প্রজাদের সম্পর্কে, পুরুষ লোককে তার পরিবারের ব্যাপারে, মহিলাকে তার স্বামীর সার্বিক ব্যাপারে, একজন পরিচালক তার মালিকের সম্পদের রক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। (বোখারি-৮৯৩, মুসলিম-১৮২৯)।

মুসলমান নিজ ও নিজের পরিবারের পাশাপাশি নিজের আওতার মধ্যের সবাইকে এবং রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক প্রজাদের অশ্লীলতার থেকে বিরত রাখতে হবে। কেননা এটা মুসলমানদের মৌলিক দায়িত্বের অন্যতম। অশ্লীলতার প্রসারের ব্যাপারে আল্লাহ ভয়ংকর শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা চায় যে, মোমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার-প্রসার ঘটুক তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’ (সুরা নুর : ১৯)।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ সব বিধর্মীদের প্রচলিত নির্ধারিত রীতিনীতিগুলো পরিহারকরত ইসলামি রীতিনীতি প্রচার ও প্রসার ঘটানো। মহান প্রভু আমাদেরকে তথাকথিত থার্টিফার্স্ট নাইট তথা নববর্ষ নামক ইমান বিধ্বংসী সংস্কৃতি পরিহার করার তৌফিক দিক। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত