কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা না পাওয়ায় তেল ও গ্যাসসহ বিভিন্ন সরকারি আমদানির বিল মেটাতে (এলসি) বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। ফলে এ সব ব্যাংক রেমিট্যান্স আয়ে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংক- সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ২২ দিনেই ৬৮৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রাপ্ত ৬৫৯ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি। তথ্য অনুসারে, ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পেয়েছে ১.০৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কীভাবে এত রেমিট্যান্স পাচ্ছে জানতে চাইলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানান, এখন রেমিট্যান্সের বাজার দর সংবেদনশীল। যে ব্যাংক দাম বেশি দেবে, সে ব্যাংকই রেমিট্যান্সের ডলার পাবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে ১২২.৭০ টাকা পর্যন্ত রেট দিচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংকই ১২২ টাকার এর বেশি রেট দিতে পারে না। তাই, বেসরকারি ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স তুলনামূলক কম পাচ্ছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, ‘রেমিট্যান্সের ডলারের দাম নিয়ে এ ধরনের বিভেদ আগেও ছিল, তবে এখন উদ্দেশে বদল ঘটেছে। আগে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ইচ্ছামতো দাম দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতো। এর একটা বড় অংশই বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেশি দাম দিচ্ছে। তবে এ সব ডলার রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার সাপোর্ট পেতো। তবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করার কারণে সেটি ক্রমাগত কমে যাচ্ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রিজার্ভ মেইন্টেইন করতে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে।’ ‘এখন এ সব ডলার আমাদের বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রের স্বার্থে কিছুটা বেশি দাম দিয়ে হলেও আমাদের রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি। এলএনজি আমদানি ও বিদেশি একটি কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট রেভিনিউ ডিসবার্স করতে প্রতিমাসে অন্তত ১৫০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয় মন্তব্য করে আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ‘পেট্রোবাংলার স্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানির জন্য প্রতিমাসে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পেমেন্ট করতে হয়। এছাড়া বিদেশি একটি এনার্জি কোম্পানির রেভিনিউ ডিসবার্স করতে হয় মাসে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার।’
‘এই পেমেন্টগুলো ঠিক সময়ে না করলে কান্ট্রি রেটিংয়ে প্রভাব পড়ে, যেটি দিনশেষে একটি দেশের সুনাম ও সক্ষমতার ওপর প্রশ্ন তোলে। ফলে দেশের স্বার্থে আমাদের এ সব ডলার সংগ্রহ করতেই হয়,’ যোগ করেন তিনি। পেমেন্ট করা বাড়িয়ে দেয়ার ফলে ওভারডিউ পেমেন্টের ব্যালেন্স আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পেমেন্টগুলো ক্লিয়ার করতে। তবে আমাদের বুঝতে হবে ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। ফলে মার্কেটে ডলারের দামের ওপর একটা চাপ তো থাকেই। তবে এটিকে মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ডলার দর ১২৮ টাকায় উঠে যায়। তাতে কয়েক মাস ডলার দর স্থিতিশীল থাকার পর আবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ১৩ ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত ডলার দরের চাইতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে বেশি দামে কেন ডলার কেনা হয়েছে, সেই ব্যাখ্যা চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংকগুলো ব্যাখ্যাও দেয়। ডিসেম্বর মাসেই ওই ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী। ট্রেজারিদের তিনি নির্দেশনা দেন ১২৩ টাকার ওপরে দর দিয়ে যেন কোনো ব্যাংক রেমিটেন্স সংগ্রহ না করে। পরে সেটিকে আরও কমিয়ে ১২২ টাকায় নিয়ে আসা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার পর প্রায় তিন সপ্তাহ রেমিট্যান্সের ডলারের দর ১২২ টাকার মধ্যে ছিল মন্তব্য করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। প্রথম দিকে ২০-৩০ বেসিস পয়েন্ট বাড়লেও ফেব্রুয়ারিতে সেটি আরও বেড়েছে। বর্তমানে রেমিট্যান্সের ডলার সর্বোচ্চ ১২২.৭০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে।’