ঢাকা সোমবার, ১১ আগস্ট ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অনটন আর হতাশায় কাপ্তাইয়ের জেলেরা

প্রজনন মৌসুমে তিন মাসের অনুদানে সাত দিনও চলে না
অনটন আর হতাশায় কাপ্তাইয়ের জেলেরা

২০ কেজি চালে সংসার চলে না! হঠাৎ রুক্ষ হয়ে ওঠে রনজি দাসের কণ্ঠ। কাপ্তাই হ্রদের ওপারে নৌকা ভিড়াচ্ছেন তিনি, কিন্তু চোখে যেন ঘূর্ণায়মান ঢেউয়ের বদলে ফুটে উঠছে বাজারের খরচ, ছেলেমেয়ের স্কুলের ফি আর ঔষধের দামি প্রেসক্রিপশন।

রনজিতের পরিবারে সদস্য ছয়জন। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বড় ছেলের স্কুলে পরীক্ষা, ছোট মেয়ের বুক খারাপ, আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধের প্যাকেট হাতে নিলেই মাথায় যেন বাজ পড়ে। অথচ বছরের এই তিন মাসে তার একমাত্র জীবিকা মাছ ধরা নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। উদ্দেশ্য মহৎ-মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন, অবমুক্তকৃত পোনার বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদে হ্রদের মৎস্য উৎপাদন নিশ্চিত করা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই ২৬ হাজারেরও বেশি জেলে পরিবার, যারা কাপ্তাই হ্রদকেই জীবনের অবলম্বন বানিয়ে টিকে আছেন।

বিএফডিসি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবারের সদস্যসংখ্যা গড়ে ৭৮ জন। বছরে নয় মাস মাছ ধরে তারা কোনোমতে সংসার চালালেও বাকি এই তিন মাস তাদের জন্য দুঃস্বপ্ন। সরকার এই সময় পরিবারপ্রতি ২০ কেজি চাল বরাদ্দ রাখে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায়। কিন্তু এই চাল দিয়ে এক সপ্তাহও পেট চলে না-এমনটাই বলছেন জেলেরা।

পুরাতন জালিয়াপাড়ার মিনতি দাস বললেন, মাছ ধরতে পারি না তিন মাস। চাল পাই ২০ কেজি। কিন্তু ডাল, তেল, নুন কই? বাচ্চার স্কুল, স্বামীর ওষুধ সবই বন্ধ থাকে। এনজিও থেকে ঋণ না নিলে হয় না। কিন্তু ওটার চাপ পরে সারা বছর।

নতুন জালিয়াপাড়ার জগদীশ দাসের চোখে মুখে উদ্বেগ, চোখে অন্ধকার দেখি এই সময়টায়। মাছ না ধরলে পেটে ভাত পড়ে না। যদি সরকার চালের সঙ্গে ডাল-তেল দিত, বা কোনো রেশন ব্যবস্থা করত, তাহলে অন্তত তিন মাস টিকে থাকা যেত।

অনেকে এই সময় বাজারে শাকসবজি, কাঁকড়া, কুনো ব্যাঙ, এমনকি শামুকও বিক্রি করেন। কারো পরিবারে নারী সদস্যরা কাজ নেন প?রের ঘ?রে বা পাহাড়ি ঝিরিতে লাকড়ি সংগ্রহে। আবার কেউ কেউ সুদের উপর ঋণ নেন এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে। কিন্তু সেই ঋণের বোঝা তারা টানেন বছরের পর বছর।

জেলেরা সাহায্য বা দান চান না, চান সম্মানের সঙ্গে বাঁচার নিশ্চয়তা। তারা চান মৌসুমভিত্তিক সুরক্ষা, টিকে থাকার গ্যারান্টি, বিকল্প আয়ের পথ। কাপ্তাই হ্রদ শুধু জীবিকার উৎস নয়, এটি তাদের জীবন ও পরিচয়ের অংশ। কিন্তু বছর বছর এই নিষিদ্ধ মৌসুম তাদের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

একজন প্রবীণ জেলে বললেন, এই তিন মাসে আমরা ভিখারির মতো হয়ে যাই। কেউ চাল দেয়, কেউ ঋণ দেয়, কেউ গালি দেয়। অথচ বাকি নয় মাস এই হ্রদের মাছ দিয়েই রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, ঢাকা সব জায়গার চাহিদা মেটাই। স্থানীয়দের মতে, একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়া জেলেপরিবারগুলোর দুঃখ দূর হবে না। তাদের প্রস্তাব : প্রতি মাসে চাল, ডাল, তেল, লবণসহ মাসিক রেশন প্যাকেজ চালু করা, সহজ শর্তে বিনা জামানতে ঋণ সুবিধা, বিকল্প কর্মসংস্থান হাঁস-মুরগির খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশিক্ষণ, কুটির শিল্প, ছাত্রদের জন্য মৌসুমি বৃত্তি/শিক্ষা ভাতা, হ্রদণ্ডনির্ভর পরিবারগুলোর জন্য ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ সহায়তা এবং জেলে নিবন্ধন ও ডিজিটাল রেশন কার্ড সিস্টেম চালু করা। জাতীয় অর্থনী?তির গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার ৭২৫ বর্গ?কি?লো?মিটা?রের কৃ?ত্রিম বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদ শুধু একটি জলাধার নয়; এটি একটি জীবনধারা, একটি অর্থনৈতিক মহা-চক্র, আর হাজারো জেলের স্বপ্নভবনের ভিত্তি। কিন্তু এই নিষিদ্ধ মৌসুমে সেই ভবন কেঁপে ওঠে অনাহার, ঋণ আর অপমানের ঝড়ে। জেলেরা চায় না দয়া। তারা চায় সম্মানিত সহায়তা, ন্যায্য অধিকার ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ।এই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ঝড়-তুফান ও প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে বছর বছর ধরে কাপ্তাই হ্রদের জেলেরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু যতদিন না তাদের জন্য কার্যকর পুনর্বাসন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ততদিন ‘২০ কেজি চালে সংসার চলে না’ এই আর্তনাদ হয়তো কাপ্তাই হ্রদের ঢেউয়ে ঢেউয়ে নিঃশব্দে বয়ে চলবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত