বাংলাদেশে ইলিশের রয়েছে চারটি প্রজনন ক্ষেত্র ও ছয়টি অভয়াশ্রম। তারমধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র। বিগত কয়েক বছর ধরে নদীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, ডুবোচর ও নদী তীরবর্তী শিল্পাঞ্চল নির্মাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের বিচরণসহ সার্বিক জীবনচক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। হুমকিতে পড়েছে এর প্রজনন। ফলে সরকারী নানাবিধ উদ্যোগের পরও বাড়েনি ইলিশের উৎপাদন।
মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, সাগরে ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে প্রতি বছর দুই দফায় ৮৭ দিন মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এছাড়া প্রতি বছর ৮-১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পালিত হয় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ। ১ নভেম্বর থেকে ৮ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এত কিছুর পরও সাগরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে না। গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ইলিশ আহরণ কমেছে ২৯০ টন।
২০২০ সালে ইলিশ আহরণ হয় ৩২৭ দশমিক ৪ টন। এতে স্থানীয় জেলেদের মাঝে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। তবে ২০২১ সালে এসে ধাক্কা খান এখানকার জেলেরা। সেই ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেননি মিরসরাইয়ের ২৯টি জেলে পাড়ার কয়েক হাজার জেলে। ওই বছর ইলিশ আহরণ হয় ২৫২ দশমিক ৩ টন। এভাবে প্রতি বছর কমতে থাকে ইলিশ আহরণ। ২০২২ সালে আহরণ হয় ১৪৭ দশমিক ৪ টন। ২০২৩ সালে আহরণ হয় ১১৬ টন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ইলিশ আহরণ নেমে যায় তলানিতে। ওই বছর আহরণ হয় মাত্র ৩৬ দশমিক ৪৯ টন।
মিরসরাইয়ে ২৯টি জেলেপাড়ায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন দুই হাজার ৫৫৭ জন। ২০১৬ সালের আগে দুই হাজার ২৬ জন জেলে নিবন্ধিত হন। ২০২১ সালে নিবন্ধিত হন ১০০ জন। এর পরবর্তী বছরগুলোয় নিবন্ধন পান আরও ৪৩১ জেলে। মৎস্যজীবীরা বলছেন, মিরসরাইয়ের সাগর পাড়ে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠায় ইলিশ আহরণ কমেছে। এরইমধ্যে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। উৎপাদনে গিয়েছে একাধিক শিল্প-কারখানা। এসব কারখানার বর্জ্য যদি সাগরে পড়ে তাহলে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মায়ানি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের জেলে লক্ষণ জলদাশ বলেন, প্রতি বছর মৌসুম এলেই দাদনে জাল কিনতে হয়। পরে ইলিশ আহরণ করে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হয়। বিগত কয়েক বছর ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে সাগরে ইলিশ উৎপাদন কমেছে।’
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দুই দফায় ৮৭ দিনের নিষেদ্ধাজ্ঞা, জাটকা ধরায় আট মাসব্যাপী নিষেধাজ্ঞা ও জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন। ২০ মে থেকে সাগরে ৬৫ দিনের জন্য মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়। ওই সময় উপজেলার দুই হাজার ১২৬ জেলে পরিবারকে দুই দফায় ৮৬ কেজি চাল সহায়তা দেয়া হয়। ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময়টাতে উপজেলার এক হাজার ৫০০টি জেলে পরিবার পায় ২৫ কেজি করে চাল। এছাড়া নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরায় নিষেদ্ধাজ্ঞার কারণে ৬২০ পরিবারকে প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারণে ঘাটগুলো বদলে ফেলায় ইলিশ আহরণ কমছে। ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে আমরা নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোয় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।