ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ৪ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দেশে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ব্যাংক করার উদ্যোগ

দেশে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ব্যাংক করার উদ্যোগ

দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই ব্যাংকের কাজ হবে মূলত নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও বর্তমান ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। এখনকার ক্ষুদ্রঋণদানকারী বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলো সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয় হিসেবে আমানত নিতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে এ ব্যাংক। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে না, অর্থাৎ, এসব ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে কেনাবেচার যোগ্য হবে না।

সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পরই ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের খসড়া তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে খসড়াটি তৈরি করে দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও এমআরএ খসড়ায় যোজন-বিয়োজন করেনি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দাবি করছিল। কিন্তু কোনো সরকারই তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৭ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ক্ষুদ্রঋণ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধনের দিন তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে দেশে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অধ্যাপক ইউনূস সেদিন বলেছিলেন, ক্ষুদ্রঋণই ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ। এ ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকের মতো হবে না। ব্যাংক চলবে বিশ্বাস ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে, যেখানে ঋণ নিতে জামানত লাগবে না। পাশাপাশি এ ব্যাংকের বড় উদ্দেশ্য হবে সামাজিক ব্যবসাকে ছড়িয়ে দেওয়া। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের একটি প্রাথমিক খসড়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার-এর ওপর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এরপর চূড়ান্ত খসড়া তৈরির কাজ হবে।’ দেশে এখন ক্ষুদ্রঋণ দেয় এনজিওগুলো। এমআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৮৩। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া সদস্য ৩ কোটি ২৩ লাখ, যাদের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ নারী।

কী কাজ করবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক : দেশে এখন ক্ষুদ্রঋণ দেয় এনজিওগুলো। এমআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৮৩। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া সদস্য ৩ কোটি ২৩ লাখ, যাদের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ নারী। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন সদস্যরা। সদস্যদের সঞ্চয় স্থিতি আছে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। আর ঋণস্থিতি (যা বর্তমানে আছে) ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ব্র্যাক, আশা, বুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, এসএসএস, সাজেদা ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন ও শক্তি ফাউন্ডেশন- এই ১০টি দেশের শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান।

দেশের বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষুদ্রঋণ খাতের প্রবৃদ্ধির স্বার্থে এবং এ খাতকে যুগোপযোগী করার প্রয়োজনে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক হতেই পারে। তবে দেখতে হবে যে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো কী চায়। আবার ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জন্য তা ভালো হবে কি না, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বিধান করতে গিয়ে অবশ্য তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না। শুধু ঋণ নয়, উদ্যোক্তাদের ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, বিপণন, কারিগরি ও প্রশাসনিক পরামর্শও দেবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক—বলা আছে আইনের খসড়ায়।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন হবে ১০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের ৬০ শতাংশ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাণ্ডশেয়ারমালিকেরা দেবেন। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ জোগান দেবেন উদ্যোক্তারা। সূত্র জানায়, প্রচলিত ব্যাংকে ধনিক গোষ্ঠী হয়ে থাকেন মূল উদ্যোক্তা। আর এ ব্যাংকের ৬০ শতাংশের মালিকানা থাকবে গরিবদের হাতে। প্রচলিত ব্যাংকের লভ্যাংশ উদ্যোক্তারা নিয়ে নেন। এ ব্যাংকের লভ্যাংশ ৪০ শতাংশ মালিকানার উদ্যোক্তারা ততটুকুই নিতে পারবেন, যতটুকু তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ হবে সাত সদস্যের। তাদের মধ্যে তিনজন পরিচালক হবেন ঋণগ্রহীতাণ্ডশেয়ারমালিকদের মনোনীত। আর অন্য তিনজন হবেন শেয়ারমালিকদের (যারা ঋণগ্রহীতা নন) মনোনীত। পদাধিকারবলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) থাকবেন পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। শুধু ঋণ নয়, উদ্যোক্তাদের ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, বিপণন, কারিগরি ও প্রশাসনিক পরামর্শও দেবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক- বলা আছে আইনের খসড়ায়। আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক স্থানীয় বা বিদেশি সহায়তা নিতে পারবে, নিতে পারবে অনুদানও। এ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে না। সূত্রগুলো জানায়, এ ব্যাংকের নামকরণ শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক হিসেবে থাকবে না। বদলে এটি হবে ক্ষুদ্র অর্থায়ন ব্যাংক, যা অন্য দেশেও আছে।

লাইসেন্স দেবে কে : খসড়ায় বলা হয়েছে, এমআরএর আওতায় একটি আলাদা বিভাগ বা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে এ ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে। নতুন বিভাগটি পরিচালিত হবে একজন প্রধান নির্বাহীর মাধ্যমে। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসায়ে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোই তাদের নামের অংশ হিসেবে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে। অন্যরা নয়। ব্যাংকাররা অবশ্য বলছেন, ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত