ঢাকা বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

চোগলখুরি এক ভ্রাতৃঘাতী পাপ

শায়খ ড. হুসাইন বিন আবদুল আজিজ আলে শাইখ
চোগলখুরি এক ভ্রাতৃঘাতী পাপ

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিগুলোর একটি হলো, মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক দৃঢ় করা এবং সব ধরনের শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির উপাদানগুলো কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই মহান মূলনীতিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে একটি ভয়ংকর অভ্যাস ও ঘৃণ্য গুণ। আর তা হলো, মানুষের মধ্যে কথা লাগানো, ফেতনা সৃষ্টি করা, শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়ানো। শরিয়তের পরিভাষায় একে নামিমা বা চোগলখুরি বলা হয়।

চোগলখুরি মানুষের ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, একতা বিনষ্ট করে, সমাজে বিভেদ ছড়ায়। এ পর্যন্ত কত সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, কত কলহের জন্ম হয়েছে, তার হিসাব নেই। এ কারণেই কোরআন ও হাদিসে একে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামি পণ্ডিতরা একে মারাত্মক অপরাধ বা কবিরা গোনাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, ‘আর অনুসরণ করো না তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়। যে কল্যাণের কাজে বাধা দান করে, যে সীমালঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ।’ (সুরা কালাম : ১০-১২)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বোখারি : ৬০৫৬)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।’ (মুসলিম : ১৯১)। আলেমরা বলেন, ‘নাম্মাম’ হলো কারও কথা শুনে তা অন্যের কাছে লাগানো, যাতে বিভেদ সৃষ্টি হয়। আর ‘কাত্তাত’ হলো, কারও কথোপকথন গোপনে শুনে তা অন্যদের কাছে লাগানো।

চোগলখুরি অনেক হারাম ও ধ্বংসাত্মক পাপ একত্র করে। এজন্য কোরআন ও হাদিসে যে সমস্ত বিশ্বাসঘাতকতার নিষেধ এসেছে, তা চোগলখুরির নিষিদ্ধতার প্রমাণ বহন করে। কারণ, যদি চোগলখোর ব্যক্তি সত্য কথা বলে, তাহলে সে যার কথা বলেছে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর যদি মিথ্যা বলে, তাহলে সে আরও বড় অপরাধী ও স্পষ্ট মিথ্যাবাদী। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টদের কথা বলব? তারা হলো যারা আপনজনদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টি করে, এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে চোগলখুরি করে, আর নির্দোষ লোকদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

সত্যিই, চোগলখুরি এক ভয়াবহ ফিতনার উৎস। এর ফলে সমাজে ব্যাপক ফাসাদ সৃষ্টি হয়, মানুষ একে অপরের শত্রু হয়ে পড়ে এবং শান্তি ও সম্প্রীতি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই ইসলাম এই অভ্যাসকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।

চোগলখুরির জঘন্য দিক হলো, এতে আরও একটি ভয়ংকর গোনাহ যুক্ত হয়ে যায়, আর তা হলো গিবত, যা ইসলামে বড় কবিরা গোনাহগুলোর একটি। এ বিষয়ে আলেমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক নীতির কথা বলেছেন যে, প্রত্যেক চোগলখুরি গিবত; কিন্তু প্রত্যেক গিবত চোগলখুরি নয়। কারণ, চোগলখুরি হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কী বলেছে, তা সেই লোকটির অজান্তে অন্যজনের কাছে গিয়ে বলা, যার ফলে তার মনে রাগ বা বিরক্তি তৈরি হয়। সাধারণত যিনি ওই কথা বলেছেন, তিনি চান না সেটি অন্যের কাছে প্রকাশ হোক। এ কারণেই মহানবী (সা.) চোগলখুরির শাস্তির একটি ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) একবার দুটি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তিনি বললেন, এদের আজাব দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন প্রস্রাব থেকে সতর্ক থাকত না। আর অপরজন চোগলখুরি করে বেড়াত।’ (বোখারি : ২১৮)।

আলেমগণ বলেছেন, ‘যার কাছে কেউ চোগলখুরি করে কথা লাগিয়ে দেবে, তার দায়িত্ব হলো ছয়টি বিষয় অনুসরণ করা।

১. ওই চোগলখোরের কথা বিশ্বাস করবে না।

২. তাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।

৩. সে যা বলেছে, তা যাচাই-বাছাই করবে ও ধৈর্য ধরবে।

৪. যার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করবে না।

৫. ওই কথার কারণে কাউকে অনুসন্ধান বা গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে খোঁজ করবে না।

৬. নিজেও ওই লাগানো কথা অন্যদের মাঝে ছড়াবে না। বরং আল্লাহর সাহায্য চেয়ে, শুধু তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এগুলো এড়িয়ে চলবে।

এ রকম ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ ও বুঝদার লোকদের আচরণ আমরা সালাফদের মাঝে দেখতে পাই। এক ব্যক্তি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর কাছে গিয়ে বলল, ‘অমুক ব্যক্তি আপনাকে গালি দিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘ওটা তো তার নিজের আমল, সে যা খুশি লিখুক তার আমলনামায়।’ আরেকজন ইমাম শাফি (রহ.)-এর কাছে গিয়ে বলল, ‘অমুক আপনাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে।’ তিনি বললেন, ‘যদি তুমি সত্য বলো, তবে তুমি চোগলখোর; আর যদি মিথ্যা বলো, তবে তুমি ফাসিক।

সুতরাং আমাদের থেকে দূরে থাকো ও চলে যাও।’ অনুরূপভাবে এক ব্যক্তি ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (রহ.) কাছে গিয়ে বলল, ‘অমুক আপনাকে গালি দিয়েছে।’ তিনি বললেন, ‘শয়তান কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে তার বার্তাবাহক বানাতে পারেনি?’ আরেক ব্যক্তিকে বলা হলো, ‘অমুক তোমার নামে খারাপ বলেছে।’ সে বলল, ‘সে তো আমাকে একটা তীর মেরেছে, কিন্তু তাতে আমি আহত হইনি। তুমি কেন সেই তীর তুলে এনে আমার হৃদয়ে বিঁধলে?’ সুতরাং, হে মুসলমান ভাইয়েরা, যে ব্যক্তি তার জিহ্বাকে হেফাজত করে, সে সফল হয় ও নিরাপদ থাকে। আর যে জিহ্বা দিয়ে ভালো কাজ করে, সে উন্নতি লাভ করে। মহাগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।’ (সুরা কাফ : ১৮)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বোখারি : ৬০১৮)। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে জিহ্বা হেফাজত করা ও চোগলখুরি করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন।

(২৩-০১-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১৮-০৭-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত