ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

নবুয়তের প্রমাণ ও মুশরিকদের অবস্থান

শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মাদ আল কাসিম
নবুয়তের প্রমাণ ও মুশরিকদের অবস্থান

আল্লাহতায়ালার বড় বড় নেয়ামতের অন্যতম হলো, তিনি তাঁর বান্দাদের কাছে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। কারণ, দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা ও কল্যাণ পাওয়ার একমাত্র পথই হলো নবী-রাসুলের পথ। ভালো ও মন্দের বিস্তারিত জ্ঞানও শুধু তাঁরাই দিতে পারেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভও একমাত্র তাঁদের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই মানুষের দেহের জন্য রাসুলদের প্রয়োজন আত্মার চেয়েও বেশি জরুরি। পৃথিবীতে যতদিন মানুষের মধ্যে নবুয়তের প্রভাব থাকবে, ততদিনই এ দুনিয়া টিকে থাকবে। আল্লাহতায়ালা রাসুলদের প্রমাণসহ পাঠিয়েছেন, যাতে তাঁদের সত্যতা স্পষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কাছে কি সংবাদ আসেনি তোমাদের পূর্ববর্তীদের, নুহের সম্প্রদায়ের, আদের, সামুদের ও তাদের পরবর্তীদের? এদের বিষয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনসহ এদের রাসুল এসেছিল।’ (সুরা ইবরাহিম : ৯)।

আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়তের প্রমাণ ও মুজিজাগুলো বিভিন্ন রকমের এবং তা অন্য যেকোনো নবীর মুজিজার চেয়ে বেশি ও বড়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি এদের জন্যে আমার নিদর্শনাবলি ব্যক্ত করব, বিশ্বজগতে ও এদের নিজেদের মধ্যে; ফলে এদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এটাই সত্য।’ (সুরা হামিম সেজদা : ৫৩)।

যখন কোরআন নাজিল হলো ও তার মধ্যে থাকা স্পষ্ট মুজিজা মুশরিকরা দেখল তখন তারা বলল, এ কোরআন যদি মক্কা বা তায়েফের কোনো বড় ও সম্মানিত ব্যক্তির ওপর নাজিল হতো, তাহলে মানা যেত! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তারা বলে, এই কোরআন কেন নাজিল করা হলো না দুই জনপদের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?’ (সুরা জুখরুফ : ৩১)। আবার তারা যখন কোরআনের মতো রচনা আনার চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে পারল না, তখন মহানবী (সা.)-কে বলল, তুমি এই কোরআনের বদলে অন্য কোনো কোরআন আনো, অথবা একে বদলে দাও। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না তারা বলে, অন্য এক কোরআন আনো এটা ছাড়া বা একে বদলাও। বলো, নিজ থেকে এটা বদলানো আমার কাজ নয়।’ (সুরা ইউনুস : ১৫)। পরে যখন তারা বুঝল যে, বিশ্বনবী (সা.) নিজে কোরআন বদলাতে পারেন না, তখন তারা চাইলো, কোরআন যেন একসঙ্গে একবারে নাজিল হয়। আল্লাহ বলেন, ‘কাফেররা বলে, সমগ্র কোরআন তাঁর কাছে একবার অবতীর্ণ হলো না কেন?’ (সুরা ফুরকান : ৩২)।

এরপর তাদের অহংকার ও জেদ আরও বেড়ে গেল। তারা এমন দাবি তুলল যে, মহানবী (সা.) যেন আকাশে মই বেয়ে উঠেন আর তারা তা দেখতেও পায়। তারপর আকাশ থেকে প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা একটি কিতাব নিয়ে আসুন, যাতে লেখা থাকবে, ‘এটা অমুকের ছেলে অমুকের নামে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো কিতাব।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত এদের প্রত্যেকেই কামনা করে যে, তাকে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ দেওয়া হোক।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৫২)।

যখন মুশরিকরা নিশ্চিত হলো যে, মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)-কে কোরআনের মতো এক মহা মুজিজার মাধ্যমে সাহায্য করেছেন, তখন তারা অহংকার ও একগুঁয়েমি করে তাঁর নবুয়তকে অস্বীকার করল। তারা বলল, ‘তাঁর সঙ্গে কোনো ফেরেশতা অবতরণ করল না কেন, যে তাঁকে সাহায্য করত?’ তারপর আরও বাড়িয়ে বলল, ‘আমাদের কাছে তো একদল ফেরেশতা আসা দরকার ছিল পেছনে পেছনে ও দলে দলে, যারা আমাদের বলে দিত যে, তুমি হে মুহাম্মাদ, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে প্রেরিত রাসুল।’ এরপর তারা এতটাই অহংকারে পড়ে গেল যে, তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছেই সরাসরি কথা বলার দাবি করল। এ সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘আর যারা কিছু জানে না তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না কেন? কিংবা কোনো নিদর্শন আমাদের কাছে আসে না কেন?’ (সুরা বাকারা : ১১৮)।

এরপর তারা নিজেদের বড় মনে করে বলল, আমরা তখনই বিশ্বাস করব, যখন আমাদের কাছেও ফেরেশতা আসবে, যেমনটি আসে নবীদের কাছে। কোরআনে এসেছে, ‘যখন তাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে তারা তখন বলে, আল্লাহর রাসুলগণকে যা দেওয়া হয়েছিল আমাদেরও তা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা কখনও বিশ্বাস করব না।’ (সুরা আনআম : ১২৪)। এ বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।’ (সুরা আনআম : ১২৪)।

ধর্মীয় দিক দিয়ে যখন তারা কিছুতেই নবীজিকে কষ্ট দিতে পারল না, তখন তারা দুনিয়াবি দাবি-দাওয়া করতে শুরু করল, যাতে তাঁকে অপমান করা যায়। তারা তখন মক্কার সেই নির্জন ও অনুর্বর উপত্যকায় বসে মহানবী (সা.)-কে বলল, ‘যদি তুমি সত্যিকারের নবী হও, তাহলে তোমার জন্য খেজুর ও আঙুরের বাগান হওয়া উচিত, যার মাঝে তুমি ঝরনা ও নদী বইয়ে দিতে পার।’ নবীজি যেখানে নিজের এক দিনের খাবারও সংগ্রহ করতে পারতেন না, সেখানে তারা বলল, ‘অথবা তোমার একটি স্বর্ণ নির্মিত ঘর হবে বা তুমি আকাশে আরোহণ করবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৯৩)। তারা আরও বলল, ‘আকাশ থেকে তোমার কাছে তো একটি ধনভাণ্ডার নামা উচিত ছিল, যেন তুমি তা থেকে উপকার লাভ করতে পার।’ আর নিজেরা বলল, ‘আমরা তখনই বিশ্বাস করব, যখন তুমি আমাদের জন্য মক্কার মাটি চিরে ঝরনা বইয়ে দেবে- এইদিকে ও ওইদিকে। যখন তাদের এসব দাবি বাস্তবায়িত হলো না, তখন তারা নবীজিকে বলল, ‘এটা যদি তোমার পক্ষ থেকে সত্য হয়, তাহলে আমাদের ওপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ করো কিংবা আমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দাও।’ (সুরা আনফাল : ৩২)। তারা নিজেদের সম্পর্কে এতটাই গর্ব করত যে, নবী (সা.)-কে বলতে লাগল যেন তিনি দ্রুত আজাব নিয়ে আসেন! তারা আজাবের ধরনও নির্দিষ্ট করে দিল! বলল, আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ওপর পড়ে যাক- ‘অথবা তুমি যেমন বলে থাক, তদনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে আমাদের ওপর ফেলবে বা আল্লাহ ও ফেরেশতাগণকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৯২)।

তারা আবার বলল, ‘এটা যদি তোমার পক্ষ থেকে সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করো কিংবা আমাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দাও।’ (সুরা আনফাল : ৩২)। তারা আরও কঠিন হতো যখন তাদের দাবি পূরণ না হতো। তখন তারা নবীজিকে ব্যঙ্গ করে বলত, ‘কেন তুমি নিজের পক্ষ থেকে কোনো নিদর্শন বা মুজিজা তৈরি করো না? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি যখন তাদের কাছে কোনো নিদর্শন উপস্থিত কর না, তখন তারা বলে, তুমি নিজেই একটি নিদর্শন বেছে নাও না কেন? বল, আমার প্রতিপালকের মাধ্যমে আমি যে বিষয়ে প্রত্যাদিষ্ট হই, আমি তো শুধু তারই অনুসরণ করি।’ (সুরা আরাফ : ২০৩)।

যদি কেউ নবুয়তের সত্যতা ও এর প্রমাণ জানতে চায়, তার জন্য সবচেয়ে বড় দলিল হলো মহাগ্রন্থ কোরআন। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীকেই আল্লাহ এমন কিছু নিদর্শন দিয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষ ঈমান এনেছে। আর আমাকে যেটা দেওয়া হয়েছে, সেটা হলো অহি বা প্রত্যাদেশ যা আল্লাহ আমার প্রতি নাজিল করেছেন। তাই আমি আশা করি, কেয়ামতের দিন আমার অনুসারীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি হবে।’ (বোখারি : ৪৯৮১)।

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ কোনো নবী পাঠান ও তাঁর হাতে এমন মুজিজা দেন, যা তার সত্যতা প্রমাণ করে- তখনই হুজ্জত কায়েম হয়ে যায়, সত্য সুস্পষ্ট হয়। এরপর যদি কেউ আরও নিদর্শন চায়, তবে তার দাবি মানা জরুরি নয়, বরং অনেক সময় তা মানা উচিতও নয়। কারণ, যদি এক নিদর্শনের পর আরেকটা দেওয়া হয়, তখন তারা তৃতীয়টা চাইবে; তৃতীয়টা দিলে আবার চতুর্থটা চাইবে। আর এইরকম একগুঁয়ে ও জেদি লোকদের দাবি-দাওয়া তো শেষ হওয়ার নয়।’ তাছাড়া, যাদের কাছে নবীকে পাঠানো হয়েছে, তাদের এ অধিকার নেই যে, তারা নিজেদের ইচ্ছামতো যেকোনো মুজিজা চেয়ে বসবে। নবুয়তের সত্যতা প্রমাণের জন্য মুশরিকদের এমন সব প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক নয়। তারা যেসব চাহিদা পেশ করত, তা আসলে হেদায়েত বা পথপ্রাপ্তির গ্যারান্টি নয়, বরং এর মাধ্যমে শুধু তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসলাম ধর্ম দুটি মূল বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এক. এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। দুই. এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। মানুষ যত বেশি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করবে, তত বেশি সে আল্লাহর প্রতি তাওহিদে পরিপূর্ণ ও দ্বীনে আন্তরিক হবে। আর কেউ যত বেশি রাসুলের অনুসরণ থেকে দূরে থাকবে, তার দ্বীন ততই দুর্বল ও অপূর্ণ হবে।

(৩০-০১-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৫-০৭-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত