প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৭ আগস্ট, ২০২৫
মানুষের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর, বিভীষিকাময়, আতঙ্কজনক, উদ্বেগময়, দুঃখ-কষ্ট ও অস্থিরতার সময় হলো সেই মুহূর্ত, যখন মানুষের চোখ ভয়ে স্থির থাকতে পারে না, হৃদয় গলা পর্যন্ত উঠে আসে ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কেঁপে ওঠে। তখন সে এমন ভয়াবহ দৃশ্যের সম্মুখীন হয়, যা বিরাট ও শিহরণ জাগানো রূপে চোখের সামনে উপস্থিত হয়, আর এমন কঠিন পরিস্থিতি আসে, যা শরীরকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করে। এমন ভয়ংকর একটি সময় হলো, যখন জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। এর পর হয় চিরস্থায়ী মুক্তি, অনন্ত সুখ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আনন্দ; অথবা পা ফসকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে পতিত হওয়া। সুতরাং, ধন্য সেই ব্যক্তি যে পুলসিরাত পার হয়ে নিরাপদে চলে যাবে; আর ধ্বংস সেই ব্যক্তির, পা পিছলে গিয়ে যে জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘এরা ওই দিনকে মনে করে সুদূর, কিন্তু আমি দেখছি এটা আসন্ন।’ (সুরা মাআরিজ : ৬-৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর কিয়ামতের ব্যাপার তো চোখের পলকের মতো, বরং তা অপেক্ষাও সত্বর।’ (সুরা নাহল : ৭৭)।
যা আসছে, তা নিকটবর্তী; আর দূরে চলে গেছে যা অতীত হয়েছে। কারণ তা আর কখনো ফিরে আসবে না। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু এরা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।’ (সুরা আম্বিয়া : ১)।
দুনিয়া খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, কারণ আল্লাহ একে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই সৃষ্টি করেছেন, যাতে এখানে মানুষ কাজ করে তার কর্মফল পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সেই দিন আল্লাহরই আধিপত্য; তিনিই তাদের বিচার করবেন। সুতরাং যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা অবস্থান করবে সুখদ কাননে। আর যারা কুফরি করে ও আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করে তাদেরই জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা হজ, : ৫৬-৫৭)।
এই দুনিয়ার জীবন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, আখেরাতের অনন্ত জীবনের তুলনায় মাত্র এক মুহূর্তের মতো। মহান আল্লাহ সবকিছু জানেন। সত্যবাদীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সত্যবাদী আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তিনি এদের একত্র করবেন সেদিন এদের মনে হবে, এদের অবস্থিতি দিবসের মুহূর্তকাল মাত্র ছিল; এরা পরস্পরকে চিনবে। আল্লাহর সাক্ষাৎ যারা অস্বীকার করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর তারা সৎপথপ্রাপ্ত ছিল না।’ (সুরা ইউনুস : ৪৫)। আল্লা আরও বলেন, ‘এদের যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা যেদিন এরা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন এদের মনে হবে, এরা যেন দিবসের এক দণ্ডের বেশি পৃথিবীতে অবস্থান করেনি।’ (সুরা আহকাফ : ৩৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘যেদিন কিয়ামত হবে সেদিন অপরাধীরা শপথ করে বলবে যে, তারা মুহূর্তকালের বেশি অবস্থান করেনি। এভাবেই তারা সত্যভ্রষ্ট হতো।’ (সুরা রুম : ৫৫)।
অতএব, ভাবুন তো, আদ ও সামুদের জাতি, ইবরাহিম (আ.)-এর সম্প্রদায়, লুত (আ.)-এর কওম, মাদইয়ানের লোক, ফেরাউন ও হামান, তুব্বার জাতি, পারস্য ও রোমের রাজারা এবং আগের যুগের অসংখ্য জাতি, যারা নদী বইয়ে দিয়েছিল, বাগান লাগিয়েছিল, সেরা ফল ভোগ করেছিল, সাগরের মালিক ছিল, যত চেয়েছে তত ভোগ-বিলাস করেছে। তারা কি নিয়ে দুনিয়ার সেই ‘এক ঘণ্টা’ শেষে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে? তারা নিয়ে এসেছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ, সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। দুনিয়া ও আখেরাতে ধ্বংস ও শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে শুধু সেই ব্যক্তি, যে ন্যায়পরায়ণ হবে এবং পরাক্রমশালী ও মহিমাময় আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।
মানুষের জীবনে এমন এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত আসবে, যার মতো ভয় আর কিছু নেই, যেখান থেকে পলায়নেরও সুযোগ নেই। আল্লাহ জাহান্নামের ওপর বসানো সেতু সম্পর্কে বলেন, ‘আর তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাকিদের উদ্ধার করব এবং জালিমদের সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দেব।’ (সুরা মরিয়ম : ৭১-৭২)।
এটাই সেই মুহূর্ত যখন মানুষকে জাহান্নামের ওপর স্থাপিত সেতু পার হতে হবে। সাহাবিরা এই মুহূর্তের ভয়ে কাঁপতেন, আর তাদের পরে যারা তাদের পথ অনুসরণ করেছেন, তারাও আল্লাহর ভয়ে গুনাহ ও অবাধ্যতা থেকে এই আশায় বেঁচে থাকতেন যে, আল্লাহর রহমতে তারা নিরাপদে এই সেতু পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার তিনি জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি কাঁদছো কেন? তিনি বললেন, জাহান্নামের কথা স্মরণ হওয়ায় কাঁদছি। আপনি কি কিয়ামাতের দিন আপনার পরিবারের কথা মনে রাখবেন? নবীজি (সা.) বললেন, অবশ্য তিনটি স্থানে কেউ কারও কথা স্মরণ রাখবে না। মিজানের নিকট, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জানতে পারবে তার আমলের পরিমাণ কম হবে নাকি বেশি; আমলনামা প্রাপ্তির স্থান, যখন বলা হবে, ‘তোমার আমলনামা পাঠ করো’ কেননা তখন সবাই পেরেশান থাকবে যে, তার আমলনামা ডান হাতে পাচ্ছে নাকি বাম হাতে পাচ্ছে নাকি পেছন দিক হতে পাচ্ছে; আর পুলসিরাতের নিকট, যখন তা জাহান্নামের ওপর প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ (আবু দাউদ : ৪৭৫৫)।
আল্লাহভীতি ও সৎকর্মের মাধ্যমে এই ভয়ংকর সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং গুনাহ ও অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ, ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কেয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার! যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেই দিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী বিস্মৃত হবে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে; মানুষকে দেখবে নেশাগ্রস্তসদৃশ, যদিও এরা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন।’ (সুরা হজর: ১-২)। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, সৎকাজে দ্রুত এগিয়ে যাও, আর হারাম থেকে দূরে থাকো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্যে সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ এদের আত্মবিস্মৃত করেছেন। এরাই তো পাপাচারী।’ (সুরা হাশর : ১৮-১৯)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তোমরা সেই দিনকে ভয় করো যে দিন তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। এরপর প্রত্যেককে তার কর্মের ফল পুরাপুরি প্রদান করা হবে, আর তাদের প্রতি কোনোরূপ অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৮১)। উমর (রা.) বলেছেন, ‘নিজেদের হিসাব নাও, তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে। নিজেদের ওজন করো, তোমাদের ওজন করার আগে। আর আল্লাহর সামনে বড় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত হও।’ সুতরাং আল্লাহভীতি ও সৎকর্মের মাধ্যমে সামনে যে ভয়াবহ অবস্থা আছে, তা থেকে বাঁচো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। আর অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছ থেকে অলীক আশা করে।’ (তিরমিজি : ২৪৫৯)।
মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যেখানেই থাকো আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজের পর ভালো কাজ করো, তা তাকে মুছে দেবে। আর মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো।’ (তিরমিজি : ১৯৮৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ছোট ছোট গুনাহকে তুচ্ছ মনে করো না। এগুলো জমা হতে হতে মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে।’ (তাবারানি)। অতএব, তোমরা নিজেদের মুক্ত করো ঈমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা জুলুম করেছে যদি তাদের থাকে, দুনিয়ায় যা আছে তা সম্পূর্ণ এবং এর সমপরিমাণ সম্পদও, তবে কেয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি হতে মুক্তিপণস্বরূপ সেই সবাই তারা দিয়ে দেবে। আর তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট হতে এমন কিছু প্রকাশিত হবে যা এরা কল্পনাও করেনি।’ (সুরা জুমার : ৪৭)।
(০৭-০২-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ০১-০৮-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)