প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ আগস্ট, ২০২৫
আমরা যখন নতুন শিক্ষাবর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আমরা আবার ফিরে আসছি। জ্ঞানার্জনের পরিসরে, জ্ঞান অন্বেষণের ও তা অর্জনের জন্য। ক্লাসরুম ও পাঠচক্রে, জ্ঞানমূলক মঞ্চে, সময়কে কাজে লাগানোর ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য, জান্নাতের বাগানের মতো পরিবেশে এই ফেরা অনেক কল্যাণময়। তাই হে শিক্ষার্থীরা, তোমরা নতুন শিক্ষাবর্ষকে স্বাগত জানাও পরিশ্রম, আন্তরিক নিয়ত, দৃঢ় সংকল্প ও উঁচু মানসিকতা নিয়ে। কারণ যে চেষ্টা করে, সে সফল হয়; যে বীজ বোনে, সে ফল পায়। আর সফলতা আসে আল্লাহর তাওফিকের পর কঠোর পরিশ্রম ও কাজ করার মাধ্যমে। কবি বলেছেন, ‘যে পরিশ্রম ছাড়া উচ্চ মর্যাদা কামনা করে, সে জীবনের সবটা অপচয় করে অসম্ভবের অন্বেষণে।’
জ্ঞান হচ্ছে আল্লাহর এক পূর্ণতার গুণ। তিনি সবকিছু সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। তিনি জানেন কী ঘটেছে, কী ঘটবে না, আর কী ঘটতে পারে। তিনি সবকিছুকে দয়া ও জ্ঞানে পরিবেষ্টন করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত; আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে তাঁর অগোচর নয় অণু পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কিছু; এর প্রত্যেকটি আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।’ (সুরা সাবা : ৩)। তিনিই মানুষকে শিখিয়েছেন যা আগে জানত না। তিনি তাকে এমন উপায় দিয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষ শিখতে পারে। তিনি মানুষকে দিয়েছেন বুদ্ধি, যাতে চিন্তা করে, বোঝে ও উপলব্ধি করে। কান দিয়েছেন শোনার জন্য, চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য ও জিহ্বা দিয়েছেন কথা বলার জন্য। তিনি মানুষকে কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবাধা রক্ত থেকে। পাঠ করো, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক : ১-৫)।
আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন ও তাকে পৃথিবীতে নিজের প্রতিনিধি বানিয়েছেন জ্ঞানের মাধ্যমেই। তিনি আদম (আ.)-কে সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়েছেন এবং আকাশ ও জমিনের যা কিছু আছে, সবকিছুকে তাঁর জন্য কাজে লাগিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন, যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আমি যা জানি তা তোমরা জান না। আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেই সমুদয় ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন ও বললেন, এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
তারা বলল, আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। তিনি বললেন, হে আদম, তাদের এ সকল নাম বলে দাও। সে তাদের এসবের নাম বলে দিলে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, নভোমণ্ডল ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত। আর তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রাখ আমি তাও জানি?’ (সুরা বাকারা : ৩০-৩৩)।
জ্ঞান হচ্ছে সবচেয়ে বড় নেয়ামত। এর দ্বারা জাতি উন্নত হয়, বিজয় লাভ করে। এটি সর্বোত্তম ইবাদত ও উত্তম নৈকট্যের উপায়। কোরআন শিক্ষা অর্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। আর আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে জ্ঞানের বৃদ্ধি প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আর বলুন, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।’ (সুরা তহা : ১১৪)। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, ‘এটা স্পষ্ট প্রমাণ যে, জ্ঞানের মর্যাদা কত বড়; কারণ আল্লাহ তাঁর নবীকে কোনো কিছুর বৃদ্ধির দোয়া করতে বলেননি, শুধু জ্ঞানের ক্ষেত্রে বলেছেন।’ মহান আল্লাহ আলেমদের মর্যাদা বাড়িয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাঁকে ভয় করে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা ফাতি : ২৮)।
তিনি আলেমদের নিজের ও ফেরেশতাদের সঙ্গে একসঙ্গে সাক্ষ্যদাতা করেছেন তাঁর একত্বের ব্যাপারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাসক নেই, ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই; তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮)। মহান আল্লাহ আলেমদের মর্যাদার কথা বলেছেন যে, ‘যারা জানে ও যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার : ৯)। আল্লাহতায়ালা আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা করো।’ (সুরা নাহল : ৪৩)।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন।’ (বোখারি : ৭১)। তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোনো পথে বের হয়, আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (মুসলিম : ৬৭৪৬)। আমাদের পূর্বসূরিরা জ্ঞান অর্জনের জন্য কত কষ্ট করেছেন! তারা প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে দূরে গেছেন, অভাব-অভিযোগ, কষ্ট, দুর্দশা ও ক্লান্তি সহ্য করেছেন শুধু জ্ঞানের জন্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের সকলের একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সংগত নয়, এদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে আর তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে যাতে তারা সতর্ক হয়।’ (সুরা তওবা : ১২২)। অতএব, হে ছাত্রছাত্রীরা, তোমরা নিজেদের সময় থেকে জ্ঞানের জন্য একটি নির্ধারিত অংশ রেখো। জ্ঞানের জন্য আলাদা সময় নির্দিষ্ট করো। কারণ জ্ঞান হলো দুনিয়ায় তোমাদের পাথেয় এবং আখেরাতে মর্যাদার উপায়।
তোমাদের জন্য যা উপকারী, তা অর্জনে দেরি করবে না। শিক্ষার সময়কে অবহেলা করো না। সময় চলে যায়, জীবন ফুরিয়ে যায়, আর যা চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ কারও জন্য মঙ্গল চাইলে তাঁকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন। আর জাহিলিয়াতের মধ্যে যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিল, ইসলাম গ্রহণ করার পর তারাই উত্তম হয় যদি তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করে। আলেমরা হলো নবীদের উত্তরাধিকারী। আর যে কেউ জ্ঞান অর্জনের জন্য কোনো পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’
জ্ঞান হলো হৃদয়ের জীবন, দৃষ্টিশক্তির আলো, বুকের রোগের ওষুধ, বুদ্ধির উদ্যান, আত্মার আনন্দ ও মন-প্রাণের সান্ত¡না। এটি বিদেশে প্রবাসীর সাথি, একাকিত্বের সময় কথোপকথনের সঙ্গী, নিঃসঙ্গতায় আপনজন ও সন্দেহ দূর করার মাধ্যম। জ্ঞানালোচনা করা ইবাদত, তা অনুসন্ধান করা জিহাদ, তা অর্জনের চেষ্টা করা নৈকট্যের কাজ, তা বিতরণ করা দান ও তা পড়া-পড়ানো ইবাদত। জ্ঞান পানাহারের চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয়। তাই হে ছাত্রসমাজ, তোমরা জ্ঞানার্জনে মনোযোগ দাও। আল্লাহ তোমাদের জন্য নানা উপায় সহজ করেছেন, সময়-সুযোগ দিয়েছেন, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দিয়েছেন, যোগাযোগেরব্যবস্থা ও শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম সহজ করে দিয়েছেন। তাই আর কোনো অজুহাত নেই পড়াশোনা থেকে দূরে থাকার। সব উপায় খোলা, সব প্রমাণ স্পষ্ট। তাই চেষ্টা করো, কষ্ট সহ্য করো, আজ বপন করো যাতে আগামীতে ফল পেতে পারো। কেননা, জ্ঞান হলো এমন আলো, যা কখনও নিভে না; এমন ফল, যা কখনও বিফল হয় না।
হে শিক্ষাগুরুগণ, আপনারা আগে নিজে শিখুন, তারপর তা শেখান, তার ওপর কাজ করুন ও ছড়িয়ে দিন। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও তত্ত্বাবধানের ব্যাপারে আপনারা আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ। তাই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবেন না। আন্তরিক পরামর্শ ও সঠিক দিকনির্দেশনা দিন। আপনারা কথায়-বার্তায় ও কাজে তাদের সামনে উত্তম আদর্শ হোন। মনে রাখুন, শিক্ষা হলো এক মহাআমানত, এক বিশাল দায়িত্ব। আপনাদের কথা ছাত্রদের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ে প্রভাব ফেলে। তাই নিয়ত খাঁট করুন, দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করুন, আর ছাত্রদের জন্য কল্যাণের সহায়ক হোন। কারণ একটি সৎ কথা বা আন্তরিক শিক্ষা কোনো মানুষের পুরো জীবন বদলে দিতে পারে, এমনকি একটি জাতিকেও পুনরুজ্জীবন দান করতে পারে।
(২১-০২-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১৫-০৮-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)