প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আমি নিজেকে ও আপনাদের তাকওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা, তাকওয়া হচ্ছে সব গুণের সমষ্টি, মুক্তির উপায়, প্রশান্তির চাবিকাঠি ও ইহ-পরকালের আশ্রয়স্থল।
‘আমি তার থেকে ভালো’ কথাটি মাঝে মাঝে জিহ্বায় চলে আসে। কিন্তু আসলে এটা শুধু মুখের কথা নয়, বরং অন্তরের এক লুকানো অনুভূতি- যা চুপিসারে হৃদয়ে ঢুকে যায় এবং আত্মার গভীরে বসে যায়, এমনকি মানুষকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। এই বাক্যটি জন্ম নেয় তুলনার ভ্রান্তি থেকে- যখন কেউ ভাবে সেই বেশি যোগ্য, সেই বেশি মর্যাদার অধিকারী, সেই উন্নতির প্রথম দাবিদার। কারণ সে মনে করে, তার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অন্যদের নেই। এরপর সে অন্যের প্রাপ্ত রিজিক, পদ বা সম্মানকে তুচ্ছ করে ফেলে এবং প্রকাশ্যে বা গোপনে বলে, আমি তার চেয়ে বেশি প্রাপ্য, আমি বেশি জ্ঞানী, আমি বেশি পবিত্র, আমি বেশি যোগ্য। প্রকৃতপক্ষে এই অনুভূতি হলো- আল্লাহর ন্যায়ের ওপর গোপন আপত্তি ও তাঁর হিকমতের ওপর সন্দেহ করা। যেন সে আল্লাহর সৃষ্টির বণ্টন ও পদমর্যাদার সিদ্ধান্তকে সংশোধন করতে চাচ্ছে। যে তুলনার ঘূর্ণিতে পড়ে, সে গোপন অহংকারের ফাঁদে ধরা পড়ে এবং প্রথম যে অহংকারী গোনাহগার ধ্বংস হয়েছিল, তার পথেই হাঁটে।
এই কথাটি শুধু জিহ্বার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং মানুষের জীবনে নানা রূপে প্রকাশ পায়। কখনও সরাসরি বলা না হলেও তা বোঝা যায় অহংকারী দৃষ্টিতে, তাচ্ছিল্যের হাসিতে, ঊর্ধ্বমুখী কণ্ঠস্বরে কিংবা অবজ্ঞার ভঙ্গিমায় নীরব থাকার মধ্যেও।
এমনকি এক সাধারণ বাক্যের ভেতরেও তা লুকিয়ে থাকতে পারে, যা অন্তরে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে। বস তার কর্মচারীদের হেয় করার সময় এটা বলে, ধনী গরিবকে হীন মনে করার সময় বলে, ধার্মিক যখন পাপীকে ঘৃণা করে তখন বলে, কেউ তার বুদ্ধি, বংশ বা জ্ঞানের গর্ব করেও বলে। এমনকি ধর্মের নামেও এটি বলা হয়, যখন কেউ ভাবে যে, শুধু তার পক্ষেই সত্য সীমাবদ্ধ, অন্যরা সবাই ভ্রান্ত। কেউ কেউ নসিহত, দাওয়াত বা বিতর্কের আড়ালেও একে লুকায়, কিন্তু আসলে তা সরল অহংকার।
যে ব্যক্তি এই কথা বলে নিজের প্রশংসা করে, নিজেকে মানুষের থেকে উঁচু মনে করে, তার এই কথা মূলত অন্তরের অহংকার, সত্যকে উপেক্ষা করা ও মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। এভাবে সেই ব্যক্তি ইবলিসের পথেই চলে, যদিও শব্দ বদলায়, রূপ পরিবর্তিত হয়। দুর্বল সৃষ্ট প্রাণী কীভাবে মহান স্রষ্টার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করতে সাহস করে? অথচ আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টি করেন, নির্ধারণ করেন, উঁচু-নিচু করেন, সম্মান দেন ও অপমান করেন। তিনিই জানেন তাঁর বান্দাদের জন্য কী উপযুক্ত। তিনি যা ফায়সালা করেন তা হিকমতের ভিত্তিতে হয়, আর তাঁর হিকমত সীমিত বুদ্ধি দিয়ে ধরা যায় না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত।’ (সুরা মুলক : ১৪)। অতএব, আল্লাহ যা আমাদের দিয়েছেন তাই আমাদের জন্য কল্যাণকর; যদিও আমাদের চোখে তা কম মনে হয়। আর তিনি আমাদের যা দেননি, তাতেও রয়েছে রহমত; যদিও আমরা তাকে বঞ্চনা ভাবি। অনেক সময় বিলম্বে আসে আড়াল করা উপকার, না পাওয়া জিনিসে থাকে বিশেষ দয়া, আর হারানোর মধ্যেই থাকতে পারে নাজাত। তাই মুমিনের উচিত সন্তুষ্টির দাস হওয়া, তুলনার বন্দি না হওয়া। বড় ভুল হবে যদি কেউ নেয়ামতকে ব্যবহার করে অন্যকে তুচ্ছ করার সিঁড়ি বানায়, বা নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বানায়। হতে পারে যাকে সে হেয় করেছ, সেই আল্লাহর কাছে তার চেয়ে অনেক উঁচু মর্যাদার অধিকারী।
শরিয়ত শুধু অহংকার থেকে সতর্ক করেই থেমে যায়নি, বরং আমাদের সামনে একটি সর্বোচ্চ আদর্শও দাঁড় করিয়েছে। ইউসুফ (আ.)-এর আদর্শ। তাঁর ছিল জ্ঞান, চরিত্র ও মর্যাদা। এরপরও যখন তিনি মিসরের আজিজের সামনে দাঁড়ালেন, তখন তিনি বলেননি, ‘আমি অমুকের চেয়ে ভালো’। কিংবা অন্যকে নিচে নামিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাননি। বরং তিনি দায়িত্বশীলতার দৃঢ় ভরসা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে দেশের ধন-ভাণ্ডারের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন; আমি তো উত্তম রক্ষক, সুবিজ্ঞ।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৫)। তিনি এ কথা বলেছেন বিনয়ী মানুষের আত্মবিশ্বাস নিয়ে, অহংকারী মানুষের গর্ব নিয়ে নয়। ইউসুফ (আ.) নিজের উচ্চতা দেখানোর জন্য কাউকে ছোট করেননি। তিনি নিজেকে অন্যের সাফল্যের মানদ- বানাননি, বরং নিজেকে দেখিয়েছেন একজন বিশ্বস্ত সেবক হিসেবে, অহংকারী দাবিদার হিসেবে নয়। আর যে ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা জাতি ও দেশের উপকারের জন্য উপস্থাপন করে, সে সওয়াব পায় ও মর্যাদা লাভ করে; আর যে অন্যকে হেয় করে নিজেকে বড় দেখাতে চায়, সে ধ্বংস হয় ও পতিত হয়।
যখন অহংকার মানুষের অন্তরে বসে যায়, তখন সমাজ নষ্ট হয়ে যায়, উন্নয়নের ধারা থেমে যায়, সহযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়ে, সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, পারস্পরিক সম্মানের সেতু ভেঙে পড়ে, হিংসা-বিদ্বেষ-প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার অন্তরে সরিষার দানার সমান অহংকারও থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ১৬৮)।
অহংকার হলো, ‘সত্যকে অস্বীকার করা ও মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করা।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লুকমান : ১৮)। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এক স্তর বিনয়ী হবে, আল্লাহ তার মর্যাদা এক স্তর উঁচু করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে এক স্তর অহংকার করবে, আল্লাহ তার মর্যাদা এক স্তর নিচু করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে হীনতাগ্রস্তদের মধ্যে হীনতমে পরিণত করবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ৪১৭৬)।
তাই যখনই কারও মনে গর্ব আসতে চায়, তার মনে রাখা দরকার যে, নেয়ামতগুলো চিরস্থায়ী নয়। আজ যা তোমার হাতে আছে, তা কাল কেড়ে নেওয়া হতে পারে। তাই ডানা ঝুঁকাও, বিনয়ী হও। আর যখন দেখো অন্য কাউকে রিজিক বা সম্পদে তোমার চেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে, তখন বলো, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার জন্য বরকত দাও, আর আমাকে আমার ভাগ্যে সন্তুষ্ট রাখো।’ আর তোমার জিহ্বা যেন সবসময় এমন দোয়ায় ভেজা থাকে, যা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে ও আমলকে ঠিক করে। তুমি আরো বলো, ‘হে আল্লাহ, আমার অন্তরকে অহংকার, আত্মপ্রশংসা, কুধারণা ও লোক দেখানো ইবাদত থেকে পবিত্র করে দাও।’
(০৬-০৩-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৯-০৮-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)