প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
চিরস্থায়ী সফলতার মূল কথা হলো, কাজ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতকে প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য না থাকার বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্যই মূলত দুনিয়া ও আখেরাতকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জান্নাত ও জাহান্নাম প্রস্তুত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হলো সুখের আসল চাবিকাঠি ও ইসলামের মূলভিত্তি। অন্য সব আমল ও ফরজ এরই ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৫৬)। সেই মজবুত হাতলই হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই মহামূল্যবান বাক্যই হলো তাকওয়ার কথা ও স্থির সত্য, যা দিয়ে আল্লাহ তাঁর সব নবীকে পাঠিয়েছেন।
প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরি হলো, তার অন্তরে এ কথায় দৃঢ় বিশ্বাস থাকা যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।’ ‘লা ইলাহা’ মানে হলো, আল্লাহ ছাড়া যাদের পূজা করা হয়, তারা কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়; আর ‘ইল্লাল্লাহ’ মানে হলো, আল্লাহ একাই ইবাদতের যোগ্য। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করা- হোক সে ফেরেশতা, নবী কিংবা অলি- সবই মিথ্যা। একমাত্র আল্লাহই আসল উপাস্য, যিনি সৃষ্টি করেন, রিজিক দেন, জীবন-মৃত্যু দেন, উপকার-অপকারের মালিক, সম্মান ও অসম্মান দেন, সঠিক পথে চালান বা বিপথগামী করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এগুলো প্রমাণ যে, আল্লাহই সত্য। আর এরা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে, তা মিথ্যা। আল্লাহ, তিনি তো সমুচ্চ, মহান।’ (সুরা লুকমান : ৩০)।
অতএব, এই বাক্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, আল্লাহ ছাড়া কারও জন্য কোনো ইবাদত বৈধ নয়। তাই মুখে বলা, মনে বিশ্বাস করা ও আমলে মান্য করা জরুরি। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘সুতরাং জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাসক নেই।’ (সুরা মুহাম্মাদ : ১৯)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ জ্ঞান নিয়ে মারা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, সে জান্নাতে যাবে।’ (মুসলিম : ৪৩)।
কালিমা তাইয়িবা শুধু মুখে বলাই যথেষ্ট নয়। সত্যিকারের বিশ্বাস মানে হলো এর দাবিগুলো মানা। আল্লাহর ফরজ মানা, তাঁর আনুগত্য করা, রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ মেনে চলা, আল্লাহকে ভালোবাসা, তাঁর সামনে বিনয় দেখানো, শুধু তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া, তাঁর আজাবের ভয় করা ও রহমতের আশা করা। যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে, অথচ মৃত মানুষকে ডাকে, গায়েবদের কাছে প্রার্থনা করে, বিপদ দূর করার জন্য তাদের কাছে চায়, সে এই কালিমার অর্থকে অস্বীকার করছে, এর বাস্তবতা নষ্ট করছে, আর এতে সে পড়ে যাচ্ছে এমন শিরকে, যা ঈমান ও ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
এই মহান কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানতে হলে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে, কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা থাকতে পারবে না। শুধু মুখে বলা নয়, বরং অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে আমল দ্বারা সেটি প্রমাণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না।’ (সুরা হুজুরাত : ১৫)। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাসক নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যে এ দুটি বিষয়ের প্রতি সন্দেহাতীত বিশ্বাস রেখে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম : ৪৪)। এই কালিমা সত্যিকার অর্থে তখনই গ্রহণযোগ্য হবে, যখন বলার মানুষটি তার কথা, বিশ্বাস ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বিনয়ী হবে, তাঁর দাবি পূরণ আদায় করবে এবং পূর্ণ ভালোবাসা, বিনয় ও আত্মসমর্পণসহ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করবে।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর দাবি হলো, বান্দা যেন একমাত্র আল্লাহর কাছে নিজের জীবন সমর্পণ করে এবং কথা ও কাজে শুধু তাঁরই দাসত্ব করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে।’ (সুরা জুমার : ৫৪)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে ও সৎকর্মপরায়ণ হয় সে তো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মজবুত হাতল।’ (সুরা লুকমান : ২২)।
এই মহান কালিমার মানে হলো, জিহ্বা যা বলে, হৃদয়ও তা বিশ্বাস করবে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর বিরোধী কোনো কাজ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ভেতরের বিশ্বাস ও বাইরের কাজে মিল থাকতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সত্যিকারভাবে অন্তর থেকে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য না থাকা ও মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল হওয়ার সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।’ (বোখারি : ১২৮)।
এই পবিত্র কালিমা শেখায় যে, আল্লাহর জন্য সব কিছু খাঁটি হতে হবে, সব কথা ও কাজে শিরক বা বিদআতের কোনো ছাপ থাকতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে, সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে। এটাই সঠিক দ্বীন।’ (সুরা বাইয়িন : ৫)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘বলো, আমি তো আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদত করতে।’ (সুরা জুমার : ১১)। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে, কিয়ামতের দিনে সেই আমার সুপারিশের সবচেয়ে যোগ্য হবে।’ (বোখারি : ৯৯)। তিনি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন তার জন্য, যে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্বেষায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে।’ (বোখারি : ৪২৫)।
এই কালিমার আরও দাবি হলো, আল্লাহকে সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসা আমাদের নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার চেয়েও উপরে স্থান দিতে হবে। আল্লাহ যা ভালোবাসেন আমরা তা-ই ভালোবাসব এবং তিনি যা অপছন্দ করেন, তা ঘৃণা করব। যারা এই কালিমায় বিশ্বাসী, তাদেরকে ভালোবাসব; আর যারা তা অস্বীকার করে, তাদের থেকে বিরত থাকব। আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা আমাদের নিজেদের, পরিবার-পরিজনের ও সব মানুষের চেয়েও বেশি হতে হবে। তবে ভালোবাসায় বাড়াবাড়ি বা অবহেলা করা চলবে না। এর নিদর্শন হলো তাঁর আদেশ মানা, নিষেধ থেকে দূরে থাকা, তিনি যা বলেছেন তা বিশ্বাস করা ও তাঁরই দেখানো পথে আল্লাহর ইবাদত করা। এ কালিমার আরও দাবি হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা করে, তাদের সাথে বৈরিতা রাখা।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে হলো, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করা যাবে না। তাই যে কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকে, মৃত মানুষের কাছে সাহায্য চায়, দূরে থাকা কাউকে ডাকে, অথবা এমন কারো কাছে সাহায্য চায় যে বিষয়টি শুধু আল্লাহই করতে পারেন, সে আসলে এই মহা কালিমার অর্থের বিরোধিতা করে। একইভাবে যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে তাঁর প্রভু বা উপাস্য গুণে শরিক করে, সেও শিরকে লিপ্ত হয়। আমাদের উচিত এই নির্দেশনাগুলো দৃঢ়ভাবে মানা এবং স্রষ্টা আল্লাহর এক হওয়ার বিশ্বাস লালন করা। কারণ তাওহিদই হলো প্রকৃত সুখের ভিত্তি ও জান্নাতে প্রবেশের একমাত্র চাবিকাঠি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে খাঁটি তাওহিদের লোক ও সত্যিকারের ঈমানদার বানান এবং আমাদের এমন সব কাজ থেকে দূরে রাখুন, যাতে শিরক বা বিদআত আছে- হোক তা প্রকাশ্য বা গোপন। এজন্য দাঈ ও আলেমদের দায়িত্ব হলো, তাওহিদ শেখানো ও কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী তার হক আদায় করা। মানুষের প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সেই উদ্দেশ্যে দাওয়াত দেওয়া, যার জন্য আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আলেমদের উচিত সঠিক জ্ঞান প্রচার করা, পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে মানুষের কাছে তাওহিদ ও আকিদার বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। কারণ এটিই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, সবচেয়ে জরুরি কাজ। আমাদের নবী (সা.) যেমন করেছিলেন, তেমনিভাবে আমাদেরও বুঝতে হবে যে, মানুষের জন্য সুখ-শান্তি, উম্মাহর জন্য ইজ্জত ও মর্যাদা- সবকিছুই নির্ভর করছে খাঁটি তাওহিদ প্রতিষ্ঠার ওপর। যতদিন তাওহিদের পতাকা উঁচু থাকবে, সুন্নাহর আলো জ্বলবে, ততদিন উম্মাহ নিরাপদ থাকবে।
(২০-০৩-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১২-০৯-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)