প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
ইসলামে নিজ স্ত্রীর সন্তানকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই, অধিকার নেই অন্য কারও সন্তানকে নিজ সন্তান বলে দাবি করার। দত্তক নেওয়ার পর শিশুর আসল পরিচয় মুছে ফেলা হারাম। এমন শর্তে চুক্তি করে দত্তক নেওয়া বা টাকার বিনিময়ে দত্তক নেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েজ।
জাহেলি যুগে আরবের লোকেরা অন্যান্য জাতির মতোই যাকে ইচ্ছা তাকেই নিজের সন্তান বলে ঘোষণা দিয়ে দত্তকের মাধ্যমে বংশভুক্ত বানিয়ে নিত। ঔরসজাত সন্তানের মতো সব সুবিধা পেত। ইসলাম আগমনের সময়েও আরব সমাজে দত্তক গ্রহণের প্রচলন ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও জায়েদ নামে এক সাহাবির লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার পিতার নাম ছিল হারেসা। তাকে সবাই জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ অর্থাৎ মুহাম্মদের পুত্র বলে ডাকত। পরে কোরআনে বিষয়টি নিষেধ করে দেওয়া হয়। এরপর সবাই তাকে জায়েদ ইবনে হারেসা বলেই ডাকা শুরু করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ তোমাদের পোষ্যপুত্রদের তোমাদের পুত্র করেননি, এগুলো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। আল্লাহ সঠিক কথা বলেন এবং সরল পথ প্রদর্শন করেন। তোমরা তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সংগত বিধান। যদি তোমরা তাদের পিতৃপরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও বন্ধুরূপে গণ্য হবে।’ (সুরা আহজাব : ৪-৫)।
কোরআনের এই বাক্যটি নির্দেশ করছে, পোষ্যপুত্র এটি হলো একটি মুখের বুলি ও গালভরা কথা মাত্র, এর পেছনে কোনো বাস্তবতা নেই। মৌখিক বুলি কোনো বাস্তবতা বা সত্যকে পাল্টাতে পারে না। অনাত্মীয়কে আত্মীয় এবং পোষ্যপুত্রকে ঔরসজাত পুত্রে রূপান্তর তার পক্ষে অসম্ভব। মৌখিক অনুশীলনের দ্বারা পালকপুত্রের মধ্যে পালক-পিতার রক্ত সঞ্চারিত হবে না, পিতার মধ্যে পুত্রসুলভ ভালোবাসা সৃষ্টি হবে না, সন্তানের মধ্যেও পিতৃত্বসুলভ আবেগ তৈরি হবে না। বস্তুত তার মধ্যে পিতার পারিবারিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব কিছুই স্থানান্তরিত হয় না। (হালাল-হারামের বিধান, ড. ইউসুফ আল-কারযাবি, অনুবাদ : আসাদুল্লাহ ফুয়াদ, পৃষ্ঠা: ৩৯১)।
ইসলাম নিজের বাবা-মায়ের পরিচয় মুছে ফেলে অন্য কারও সন্তান হিসেবে পরিচিত হওয়ার অনুমতি দেয়নি। ইসলাম বাবার ঔরস ও মায়ের গর্ভকেই সন্তানের পরিচয়ের মাপকাঠি নির্ণয় করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজের পিতাকে ছাড়া অন্য কাউকে পিতা বলে দাবি করে, তার জন্য জান্নাত হারাম।’ (বোখারি : ৪৩২৬)। লালন-পালনকারীর মৃত্যুর পর ওই সন্তান উত্তরাধিকার হিসেবে তার সম্পত্তি থেকে কোনো অংশ পাবে না। লালন-পালনকারীরাও ওই সন্তানের ওয়ারিশ হবে না। লালন-পালনকারীর সঙ্গে পালিত সন্তান পর্দার ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ইসলামের বিধান রক্ষা করে চলতে হবে।
জেনেশুনে আরেকজনের সন্তানকে নিজ পরিবার ও বংশভুক্ত করে তার জন্য ঔরসজাত সন্তানের যাবতীয় বিধি-বিধান তথা উত্তরাধিকার, পরিবারের সবার সঙ্গে পর্দাহীনভাবে অবাধে ওঠাবসা, বিয়ে ইত্যাদি সাব্যস্ত করা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে হারাম। দত্তক সন্তান কখনও আপন সন্তানের স্বীকৃতি পাবে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর বিধানে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়রা (অনাত্মীদের অপেক্ষা) একে অন্যের অধিক হকদার।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৭৫)।
এতিম বা পথশিশুকে দত্তক নিয়ে নিজের সন্তানের মতোই মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালন করা সওয়াবের কাজ। ভরণ-পোষণ, শিক্ষা-দীক্ষার ভার সবই নিজ কাঁধে তুলে নেওয়া ঈমানি দায়িত্ব। তবে সে পরিবারের কাছে তাদের বংশভুক্ত হবে না, আবার তার জন্য ঔরসজাত প্রকৃত সন্তানের বিধানগুলোও প্রযোজ্য হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি ও এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে নিকটে থাকবে; এই বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দুটি দ্বারা ইঙ্গিত করলেন এবং আঙুল দুটির মাঝে কিঞ্চিত ফাঁক রাখলেন।’ (বোখারি : ৫৩০৪)।
পোষ্য সন্তানের জন্য লালনকারীদের মা-বাবা ডাকা জায়েজ। একইভাবে তারাও সন্তানকে স্নেহ করে ছেলেমেয়ে ডাকতে পারবে। মুফতি শফি (রহ.) বলেন, ‘লালন-পালনকারীকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মা-বাবা ডাকা বৈধ হলেও অনুত্তম ও অনুচিত। কেননা এতে জাহেলিয়াতের কুসংস্কারের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যায়।’ (আহকামুল কোরআন, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৯২)।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক