প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫
আল্লাহর আনুগত্য ও ভয় অবলম্বনের মাধ্যমে মানুষ তার সম্মান ও মর্যাদা যতটা বাড়াতে পারে, ততটা অন্য কিছুর দ্বারা পারে না। আর আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপাচারের মাধ্যমে সে নিজের আত্মাকে যত হেয়, অপমানিত ও দুর্বল করে, অন্য কিছুই তাকে তত লাঞ্ছিত ও দুর্বল করতে পারে না। মানুষ আল্লাহর দিকে চলার পথে, তাঁর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের পথে, সবচেয়ে বড় যে বাধার মুখে পড়ে তা হলো, একটি পাপে লেগে থাকা এবং তা থেকে না সরে আসা। আল্লাহতায়ালা ক্ষমা, জান্নাত ও তাকওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শুধু তাদের জন্য, যারা তাদের পাপের ওপর অবিচল থাকে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে আর সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের ন্যায়, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্য, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে আর যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন এবং যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে আর নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ব্যতীত কে পাপ ক্ষমা করবে? তারা যা করে ফেলে, জেনে-শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৩-১৩৫)।
পবিত্র ও সৎ হৃদয় এবং বড় পাপে লেগে থাক- একসঙ্গে থাকতে পারে না। যে মানুষ সত্যিকার অর্থে নিজের মঙ্গল চায়, সে নিজের পথের এমন সব বাধা খুঁজে বের করে, যা তাকে আল্লাহর দিকে পৌঁছাতে বাধা দেয় এবং সে তা দূর করার চেষ্টা করে।
মুমিনের অন্তরে আশা ও ঈমানের আলোকরেখা তখনই জ্বলে ওঠে, যখন সে কোনো পাপ করলে তার কষ্ট অনুভব করে, সে চিন্তিত হয়, অনুতপ্ত হয় ও মুক্তির পথ খোঁজে- কীভাবে সে এই পাপের কাদামাটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ এমন সব নির্দেশে পূর্ণ- যা মানুষকে পাপের অন্ধকার থেকে আনুগত্যের আলোয়, অস্থিরতা থেকে শান্তির পথে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাঁর দয়ায় আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘বল, ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে; তৎপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না। অনুসরণ কর তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে উত্তম যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার, তোমাদের ওপর অতর্কিতভাবে তোমাদের অজ্ঞাতসারে শাস্তি আসার আগে।’ (সুরা জুমার : ৫৩-৫৫)।
এই আয়াতগুলো পাপাচারী ও বারবার ভুল করা বান্দাদের জন্য আশার দরজা খুলে দেয়; যেন তারা আল্লাহর এই দয়াময় আহ্বান শুনে দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠে, অবহেলা ও গাফিলতির নিদ্রা থেকে। আল্লাহ এত দয়ালু যে, তিনি তার বান্দাদের তখনও ডাকেন যখন তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তিনি তাদের রহমতের দিকে ডাকেন, যখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে। তারা যতই পাপ করে থাকুক না কেন, যতই বেশি সীমালঙ্ঘন করুক না কেন, তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি সব পাপ ক্ষমা করি।’ কারণ তিনিই ক্ষমাশীল ও দয়ালু, যিনি শাস্তিতে তাড়াহুড়া করেন না, তওবা ও ফিরে আসাকে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন, তোমরা তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাঁর আনুগত্যে আত্মসমর্পণ করো, যতদিন সময় আছে। মৃত্যুর আগে বা শাস্তি নেমে আসার আগে তাঁর দিকে ফিরে এসো, কারণ পরে অনুতাপের সুযোগ থাকবে না।
আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার অন্যতম নিদর্শন হলো, তিনি তাঁর পাপী বান্দাদের জন্য এমন কিছু পথ ও উপায় সহজ করে দিয়েছেন, যা তারা গ্রহণ করলে ধীরে ধীরে পাপ থেকে বিরত হতে পারে। এমনকি একসময় তারা পাপকে অপছন্দ করতে শুরু করে এবং সেই অপছন্দের কারণে আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করেন। তাই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে, তার উচিত এই পথগুলো আঁকড়ে ধরা।
এর মধ্যে একটি হলো, নিয়মিতভাবে তওবা ও ইসতেগফার করা। মানুষ যতবারই পাপ করুক না কেন, তার উচিত আল্লাহর কাছে ফিরে আসা, ক্ষমা চাওয়া। কারণ যদি সে এভাবে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তবে একদিন আল্লাহর রহমতে সে নিশ্চয়ই পাপ থেকে নিবৃত্ত হতে পারবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেউ কোন মন্দ কাজ করে বা নিজের প্রতি জুলুম করে পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।’ (সুরা নিসা : ১১০)।
তওবা ও ইসতেগফার বান্দার সবচেয়ে বড় সৎকাজগুলোর একটি। এটি এমন এক ইবাদত যার মাধ্যমে পাপ ক্ষমা হয়, শাস্তি দূর হয় ও পুরস্কার লাভ হয়। আর পাপ থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো, নিজেকে সৎ কাজে ব্যস্ত রাখা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব তুমি যখনই অবসর পাও একান্তে ইবাদত কর এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর।’ (সুরা ইনশিরাহ : ৮)। কারণ মানুষের মন সর্বদা কিছু না কিছু চিন্তা বা কাজে ব্যস্ত থাকে। যদি ভালো কাজে ব্যস্ত না রাখো, তাহলে তা মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে। যদি আল্লাহর আনুগত্যে ব্যবহার না করো, তাহলে তা শয়তানের আনুগত্যে লিপ্ত হবে। যদি নেক কাজ না করো, তাহলে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়বে। মানুষের মন এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এটি সবসময় অস্থির, প্রবণতা রাখে মন্দের দিকে। যদি একে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে এটি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফিতনা বা পাপের পরিবেশ থেকে দূরে থাকা। যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম ও ঈমানকে রক্ষা করতে পাপের পরিবেশ থেকে দূরে থাকে, আল্লাহ তাকে নিরাপদ রাখেন। যে শান্তি চায়, আল্লাহ তাকে শান্তি দেন। যে আল্লাহর আশ্রয় নেয়, আল্লাহ তাকে আশ্রয় দেন।
নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য পাওয়ার একটি ভালো উপায় হলো, এমন মানুষদের গল্প শোনা, যারা আল্লাহর আনুগত্যে পরিশ্রমী ছিলেন; আগের যুগের হোক বা বর্তমান সময়ের। এছাড়া তাদের সঙ্গে মেলামেশা করাও উপকারী, কারণ তাদের ভালো অবস্থা ও আচরণ ধীরে ধীরে আমাদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। মহান আল্লাহ এ বিষয়ে বলেছেন, ‘তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে রাখবে এদেরই সংসর্গে যারা সকাল ও সন্ধ্যায় আহ্বান করে এদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে।’ (সুরা কাহফ : ২৮)। মানুষের জন্য কোনো পাপ ছাড়ার শক্তি বাড়ানোর অন্যতম উপায় হলো, এই চিন্তা করা যে, পাপের কারণে তার জীবনে কী কী ক্ষতি হচ্ছে, আর পাপ ছেড়ে দিলে আল্লাহর তরফ থেকে কী বরকত ও শান্তি আসে।কারণ পাপের ওপর অটল থাকলে জীবনে আসে— দুঃখ ও কষ্ট, মন সংকুচিত হয়ে যাওয়া, ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হওয়া, হৃদয়ে ভার ও একাকিত্ব, কাজকর্মে জটিলতা, রিজিকে বরকতহীনতা, শরীরে অসুস্থতা ও মানসিক অস্থিরতা। অন্যদিকে, পাপ থেকে বিরত থাকা ও নিজের ইচ্ছাকে দমন করার মাধ্যমে দেহে প্রশান্তি, মনে শক্তি ও আলো, দুঃখ-চিন্তা থেকে মুক্তি, আত্মসম্মান বৃদ্ধি, জীবিকার সহজতা, দোয়া কবুল হওয়া, ইবাদতে আনন্দ পাওয়া এবং মানুষের কাছে ভালো নাম ও সম্মান লাভ হয়। যে ব্যক্তি সত্যিকারভাবে আল্লাহর জন্য কোনো খারাপ অভ্যাস বা পাপ ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাকে কখনও অপমান করেন না। ইমাম আবু সুলাইমান দারানি (রহ.) বলেছেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর জন্য কোনো হারাম ইচ্ছা সত্যিকারভাবে ত্যাগ করে, আল্লাহ তার হৃদয় থেকে সেই আকাঙ্ক্ষা তুলে দেন। আল্লাহ এত দয়ালু যে, তিনি কখনো এমন হৃদয়কে শাস্তি দেবেন না, যা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য পাপ ছেড়েছে।’ ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির মনে পাপের চিন্তা আসে; কিন্তু সে সেটিকে অপছন্দ করে, নিজের মন থেকে দূর করে এবং আল্লাহর জন্য সেটি ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি আরও বেশি সৎ, ধার্মিক ও তাকওয়াবান হয়ে ওঠে।’
আর পাপ থেকে দূরে থাকতে সহায়ক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর অনুগ্রহ, দয়া ও সৌন্দর্যের কথা স্মরণ করা। যে যত বেশি আল্লাহর নেয়ামত, ক্ষমা, দয়া ও পরিপূর্ণ গুণাবলি নিয়ে চিন্তা করে, তার হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ততই বাড়ে, আর ভালোবাসা যত বাড়ে, পাপ ছেড়ে দেওয়া ও আল্লাহর জন্য সব ত্যাগ করা তত সহজ হয়।
(১৮-০৪-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ১০-১০-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)