ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

আল্লাহর নামগুলো জ্ঞান ও ঈমানের আলো

শায়খ ড. হুসাইন বিন আবদুল আজিজ আলে শাইখ
আল্লাহর নামগুলো জ্ঞান ও ঈমানের আলো

সবচেয়ে উপকারী ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞান হলো- আল্লাহর আসমাউল হুসনা বা সুন্দর নামগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। এই নামগুলো আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর অর্থ, পূর্ণ গুণাবলি ও সর্বোচ্চ মর্যাদাকে নির্দেশ করে। মানুষের হৃদয়কে যে জিনিস সবচেয়ে বেশি আলোকিত করে ও বক্ষকে প্রশান্ত করে, তা হলো আল্লাহর সুন্দর নামগুলো ও মহিমান্বিত গুণাবলির জ্ঞান, যা নবুয়ত ও অহির আলো থেকে আসে। যে ব্যক্তি এই নাম ও গুণগুলোকে বিশ্বাস ও সন্তুষ্টি সহকারে গ্রহণ করে, আন্তরিকভাবে মেনে নেয়, মন ও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে এবং আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তার জ্ঞানকে শক্তিশালী করে, তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আরও গভীর হয়। তাই মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো তার হৃদয় যেন নিজের সৃষ্টিকর্তাকে চিনে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁর কাছে পৌঁছানোর উপায় খোঁজে। আর তা সম্ভব হয় শুধু মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলি জানার মাধ্যমে, যা কোরআন ও সহিহ হাদিসে এসেছে।

কোনো বান্দা যত বেশি এই নাম ও গুণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে, ততই সে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, তাঁকে বেশি ভালোভাবে চিনতে পারে, বেশি ভালোবাসে ও ভয় করে। আল্লাহর সুন্দর নামগুলো ও মহিমান্বিত গুণাবলি হৃদয়কে ভরে তোলে আল্লাহর মহিমা, শ্রদ্ধা, বিনয় ও ভয়-ভীতিতে। বান্দা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় নেই; তখন সে শুধু আল্লাহরই কাছে দোয়া করে, তাঁরই কাছে সাহায্য চায়।

আল্লাহর নামগুলো জানা ও বুঝা হৃদয়ে গভীর খোদাভীতি সৃষ্টি করে। মানুষ তখন প্রতিটি কাজকর্মে আল্লাহর তত্ত্বাবধান অনুভব করে। এতে সে তাড়াতাড়ি ভালো কাজে এগিয়ে যায়, আর নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর জন্য আছে সুন্দর সুন্দর নাম। কাজেই তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকবে; যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদের বর্জন করবে; তাদের কৃতকর্মের ফল তাদের দেওয়া হবে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮০)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাসক নেই, সুন্দর সুন্দর নাম তাঁরই।’ (সুরা তহা, আয়াত : ৮)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিরানব্বই বা এক কম একশটি নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি সেগুলো মনে রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (বোখারি, হাদিস : ২৭৩৬)। এই নামগুলো ‘মনে রাখা’ বলতে বোঝায়, শুধু মুখস্থ করা নয়, বরং অর্থ ও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনযাপন করা এবং কোরআন ও হাদিসে যেভাবে উল্লেখ আছে, সেভাবে আল্লাহর জন্য তা প্রমাণ করা।

এতে কোনো বিকৃতি, অস্বীকার, তুলনা বা মানবীয় রূপ কল্পনা করা যাবে না, কারণ আল্লাহর সত্তা ও গুণের প্রকৃতি শুধু তিনিই জানেন। আমরা শুধু বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ সর্বোচ্চ পূর্ণতার অধিকারী। কোরআনে এসেছে, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং আনআমের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এদের জোড়া। এইভাবে তিনি তোমাদের বংশবিস্তার করেন; কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ১১)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের অন্তর্র্বতী যা কিছু, তার প্রতিপালক। সুতরাং তাঁরই ইবাদত কর ও তাঁর ইবাদতে ধৈর্যশীল থাক। তুমি কি তাঁর সমগুণ সম্পন্ন কাউকেও জান?’ (সুরা মরিয়ম, আয়াত : ৬৫)। আল কোরআনে আরও এসেছে, ‘তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।’ (সুরা ইখলাস, আয়াত : ৪)।

আল্লাহ সেই মহান সত্তা যিনি সব সুন্দর নাম ও পূর্ণ গুণের অধিকারী। বান্দার উচিত হলো, কোরআনে যেসব বিষয়ে আল্লাহ নিজের থেকে কিছু অস্বীকার করেছেন, সেগুলো অস্বীকার করা। যেমন, আল্লাহ কখনো অন্যায় করেন না, কারণ তিনি পরিপূর্ণ ন্যায়বিচারক; তিনি অক্ষম নন, বরং সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। তাই আল্লাহর নামগুলো আমাদের জানা দরকার এবং উচ্চারণ, অর্থ ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। আমাদের উচিত আল্লাহর ইবাদত করা তাঁর এই নামগুলোর অর্থ অনুযায়ী, এই নামগুলো দিয়ে তাঁকে ডাকা- কখনও প্রশংসা ও ইবাদতের দোয়া হিসেবে, কখনও চাওয়া-পাওয়ার প্রার্থনা হিসেবে।

যদি বান্দা জানে যে আল্লাহ শক্তিশালী, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়, তাহলে সে শুধু তাঁর ওপরই নির্ভর করবে, অন্যের দিকে তাকাবে না। আর যদি জানে আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু ও তওবা গ্রহণকারী, তাহলে সে তাড়াতাড়ি তওবা করবে। আর যদি জানে আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা এবং অন্তরের খবর জানেন, তাহলে সে পাপ থেকে ভয় পাবে, সবসময় সতর্ক থাকবে। আর যখন দোয়া করে কোনো কিছু চাওয়ার জন্য, তখন সে আল্লাহকে সেই নামে ডাকবে যা তার প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই। যেমন- ‘হে দয়াময়, আমাকে দয়া করুন।’ ‘হে ক্ষমাশীল, আমাকে ক্ষমা করুন।’ ‘হে তওবা গ্রহণকারী, আমার তওবা কবুল করুন।’ ‘হে রিজিকদাতা, আমাকে রিজিক দান করুন।’

নবী-রাসূলদের অধিকাংশ দোয়া শুরু হতো এভাবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, কারণ দোয়া কবুল করা, সাহায্য করা ও রিজিক দেওয়া আল্লাহর ‘রুবুবিইয়া’ বা ‘পালনকর্তা’ গুণের প্রকাশ। আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, যাকে ছাড়া কাউকে ডাকা যায় না, সাহায্য চাওয়া যায় না।

হে আল্লাহ, আমাদের উপকারী জ্ঞান দাও, সৎকর্মে তাওফিক দাও, আমাদের হেদায়েতপ্রাপ্ত করো, পথভ্রষ্ট বা অন্যকে পথভ্রষ্টকারী করো না। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘বলো, ‘তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহ্বান কর বা ‘রাহমান’ নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর সকল সুন্দর নামই তো তাঁর। তোমরা সালাতে স্বর উচ্চ কর না এবং অতিশয় ক্ষীণও কর না; এই দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ১১০)।

আল্লাহর ৯৯ নাম

১. আল্লাহ- উপাসনার একমাত্র যোগ্য, ২. আর-রহমান- অসীম দয়ালু, ৩. আর-রহিম- পরম করুণাময়, ৪. আল-মালিক- জগতের একচ্ছত্র মালিক, ৫. আল-কুদ্দুস- পরম পবিত্র, ৬. আস-সালাম- শান্তি ও নিরাপত্তার উৎস, ৭. আল-মুমিন- নিরাপত্তা দানকারী, ৮. আল-মুহাইমিন- অভিভাবক ও রক্ষক, ৯. আল-আজিজ- পরাক্রমশালী, ১০. আল-জাব্বার- ইচ্ছামতো সবকিছু নিয়ন্ত্রণকারী, ১১. আল-মুতাকাব্বির- মহিমাময়, ১২. আল-খালিক- স্রষ্টা, ১৩. আল-বারি- নিখুঁতভাবে সৃষ্টিকারী, ১৪. আল-মুসাওয়ির- আকৃতি দানকারী, ১৫. আল-গফ্ফার- অপরাধ ক্ষমাকারী, ১৬. আল-কাহহার- প্রভাবশালী, ১৭. আল-ওয়াহ্?হাব- সীমাহীন দানশীল, ১৮. আর-রাজজাক- রিজিকদাতা, ১৯. আল-ফাত্তাহ- উন্মোচনকারী, ২০. আল-আলিম- সর্বজ্ঞ, ২১. আল-কাবিদ- সংযমকারী, ২২. আল-বাসিত- প্রাচুর্যদানকারী, ২৩. আল-খাফিদ- মর্যাদা হ্রাসকারী, ২৪. আর-রাফি- মর্যাদা উন্নীতকারী, ২৫. আল-মুইজ্জ- সম্মান দানকারী, ২৬. আল-মুজিল্ল- অপমান দানকারী, ২৭. আস-সামি- সর্বশ্রোতা, ২৮. আল-বাসির- সর্বদ্রষ্টা, ২৯. আল-হাকাম- বিচারক, ৩০. আল-আদল- ন্যায়পরায়ণ, ৩১. আল-লতিফ- সূক্ষ্মদর্শী ও সদয়, ৩২. আল-খবির- সব বিষয়ে অবহিত, ৩৩. আল-হালিম- সহনশীল, ৩৪. আল-আজিম- মহান, ৩৫. আল-গফুর- ক্ষমাশীল, ৩৬. আশ-শাকুর- কৃতজ্ঞতা গ্রহণকারী, ৩৭. আল-আলি- সর্বোচ্চ, ৩৮. আল-কবির- মহত্তম, ৩৯. আল-হাফিজ- সংরক্ষণকারী, ৪০. আল-মুকিত- জীবিকার যোগানদাতা, ৪১. আল-হাসিব- হিসাব গ্রহণকারী, ৪২. আল-জলিল- গৌরবময়, ৪৩. আল-করিম- উদারদাতা, ৪৪. আর-রকিব- তত্ত্বাবধায়ক, ৪৫. আল-মুজিব- সাড়া দানকারী, ৪৬. আল-ওয়াসি- সীমাহীন, ৪৭. আল-হাকিম- প্রজ্ঞাময়, ৪৮. আল-ওয়াদুদ- প্রেমময়, ৪৯. আল-মাজিদ- মহিমান্বিত, ৫০. আল-বাস- পুনরুত্থানকারী, ৫১. আশ-শাহিদ- সাক্ষী, ৫২. আল-হাক্ক- পরম সত্য, ৫৩. আল-ওকিল- ভরসাযোগ্য, ৫৪. আল-কাওই- শক্তিশালী, ৫৫. আল-মাতিন- দৃঢ়শক্তিধর, ৫৬. আল-ওয়ালি- সাহায্যকারী অভিভাবক, ৫৭. আল-হামিদ- প্রশংসার অধিকারী, ৫৮. আল-মুহসি- গণনাকারী, ৫৯. আল-মুবদি- সৃষ্টির সূচনা দানকারী, ৬০. আল-মুইদ- পুনরায় সৃষ্টি দানকারী, ৬১. আল-মুহই- জীবনদাতা, ৬২. আল-মুমিত- মৃত্যুদাতা, ৬৩. আল-হাইয়ু- চিরঞ্জীব, ৬৪. আল-কাইয়ুম- ধারক ও পালনকর্তা, ৬৫. আল-ওয়াজিদ- সন্ধানকারী, ৬৬. আল-মাজিদ- মহিমান্বিত, ৬৭. আল-ওয়াহিদ- একক, ৬৮. আস-সামাদ- অমুখাপেক্ষী, ৬৯. আল-কাদির- সর্বশক্তিমান, ৭০. আল-মুকতাদির- নিয়ন্ত্রণকারী, ৭১. আল-মুকাদ্দিম- অগ্রগামীকারী, ৭২. আল-মুআখখির- পশ্চাদপসারক, ৭৩. আল-আউয়াল- সবার আগে, ৭৪. আল-আখির- সবার পরে, ৭৫. আজ-জাহির- প্রকাশ্য, ৭৬. আল-বাতিন- অদৃশ্য, ৭৭. আল-ওয়ালি- অভিভাবক, ৭৮. আল-মুতাআলি- মর্যাদাবান, ৭৯. আল-বা?রর- কল্যাণকারী, ৮০. আত-তাওয়াব- তওবা গ্রহণকারী, ৮১. আল-মুনতাকিম- প্রতিশোধ গ্রহণকারী, ৮২. আল-আফু- ক্ষমাশীল, ৮৩. আর-রউফ- দয়ালু, ৮৪. মালিকুল মুলক- সবকিছুর মালিক, ৮৫. জুল জালালি ওয়াল ইকরাম- মহিমা ও সম্মানের অধিকারী, ৮৬. আল-মুকসিত- ন্যায়বিচারকারী, ৮৭. আল-জামি- একত্রকারী, ৮৮. আল-গানি- অমুখাপেক্ষী, ৮৯. আল-মুগনি- সম্পদদাতা, ৯০. আল-মানি- বাধাদানকারী, ৯১. আদণ্ডদার- ক্ষতিসাধনকারী, ৯২. আন-নাফি- উপকার দানকারী, ৯৩. আন-নুর- আলো, ৯৪. আল-হাদি- পথপ্রদর্শক, ৯৫. আল-বাদি- অভিনব স্রষ্টা, ৯৬. আল-বাকি- চিরস্থায়ী, ৯৭. আল-ওয়ারিস- উত্তরাধিকারী, ৯৮. আর-রশিদ - দিশাদাতা, ৯৯. আস-সবুর- ধৈর্যশীল।

(০২-০৫-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২৪-১০-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত