ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

মিডিয়া যুগে প্রভাবশালী ব্যক্তির দায়িত্ব

শায়খ ড. আবদুল বারি বিন ইওয়াজ আস সুবাইতি
মিডিয়া যুগে প্রভাবশালী ব্যক্তির দায়িত্ব

আমি নিজেকে ও আপনাদের পরহেজগারি অবলম্বন করার উপদেশ দিচ্ছি। কারণ পরহেজগারি হলো, একজন মোমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়; আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার দিনের সবচেয়ে শক্ত আশ্রয়। যে ব্যক্তি পরহেজগারি আঁকড়ে ধরে, সে সফল হয়; আর যে তা থেকে মুখ ফেরায়, সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও পথ হারায়। পরহেজগারি মানুষকে স্থির রাখে, ভুল চিন্তা-ভাবনা থেকে রক্ষা করে, মনকে অস্থিরতা থেকে বাঁচায় এবং সমাজকে বিভক্তি থেকে দূরে রাখে।

এ দ্রুতগতির ডিজিটাল যুগে অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম ও জানালা খুলে গেছে। এখন একজন মানুষের কণ্ঠ মুহূর্তেই হাজার বা লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। অনেক ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত উপস্থিতি ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতার মাধ্যমে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। কেউ আন্তরিকভাবে দান করে, কেউ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা বলে, কেউ মানুষের উপকার করে, কেউ দেশ ও ধর্মের মূল্যবোধ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে, আবার কেউ কর্মোদ্দীপনা ও আশার বার্তা দেয়। এদেরকেই আজ আমরা ‘জনপ্রিয় ব্যক্তি’ বলতে পারি। প্রভাবশালী হতে কোনো উপাধি বা ডিগ্রি জরুরি নয়; মানুষ তার কথা শোনে, কাজ দেখে ও আদর্শ নেয়। এটাই আসল প্রভাব।

একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যে সম্মান বা অবস্থানে পৌঁছায় তা একটি নেয়ামত। তবে এই নেয়ামতের মর্যাদা তখনই বাড়ে, যখন সে এর সঙ্গে থাকা দায়িত্ব বুঝতে পারে। প্রভাবশালী হওয়া শুধু সম্মান নয়, বরং এটা এক নীরব দায়িত্ব। অনুসরণকারীর সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং উপকারের গভীরতা দিয়ে এর মূল্যায়ন হয়। সত্যিকারের ঈমানদার জানে, যে প্রভাব মানুষের কল্যাণ আনে ও ঐক্য সৃষ্টি করে, সেটাই আসল সাফল্য।

কত সুন্দর হয়, যদি প্রভাবশালী ব্যক্তি বুঝে নেয় যে, তার প্রতিটি কাজ ও কথা হয়তো তার আমলনামার সবচেয়ে ভারী সওয়াব হতে পারে! যদি সে মানুষের উপকারে আসে, হতাশার মাঝে আশা জাগায়, মানুষকে তাদের প্রভুর সঙ্গে যুক্ত করে, নিজের পরিচয় খুঁজে পেতে সাহায্য করে, উন্নতির পথে এগিয়ে দেয়, জ্ঞান দিয়ে অন্ধকার দূর করে এবং ঈমানের আলোয় হৃদয় জাগিয়ে তোলে, তাহলে একটি সত্যকথা নিভে যাওয়া হৃদয়কে জাগিয়ে তুলতে পারে; একটি সুন্দর আচরণ ভাঙা সংসারকে ঠিক করে দিতে পারে; একটি ভালো উদ্যোগ পুরো জাতিকে শক্তি জোগাতে পারে।

প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি বুঝে যে, তার একটি কথা কারও জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার দৈনন্দিন জীবনের ছোট্ট কোনো ভিডিও অন্যের আচরণ বদলে দিতে পারে, তার হালকা মন্তব্য কোনো ফলোয়ারের বড় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে, তাহলে সে চিন্তা করে প্রতিটি কাজ করবে যে, আমি যা করছি, তা মানুষের জন্য গঠনমূলক না ধ্বংসাত্মক? আমি কি এমন কিছুর দিকেই মানুষকে ডাকছি, যা নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই? তার এ কথা মনে রাখা উচিত যে, স্ক্রিনের সামনে যা করি, তার প্রভাব মৃত্যুর পরেও আমাদের পেছনে পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষী হয়ে থাকবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কখনও আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে ধারণাও করে না যে, তা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, অথচ আল্লাহতায়ালা তার এ কথার কারণে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য স্বীয় সন্তুষ্টি লিখে দেন। আবার তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কখনও আল্লাহতায়ালার অসন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে চিন্তাও করে না যে, তা কোন পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে। অথচ এ কথার কারণে আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য অসন্তুষ্টি লিখে দেন।’ (তিরমিজি : ২৩১৯)।

অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি কথার আগেই তার আচরণ দিয়ে বড় দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। কখনও একটি ছোট্ট দৃশ্য একজন যুবকের হৃদয়ে নিবু হয়ে যাওয়া আলো পুনরায় জ্বালিয়ে দেয়! একটি সৎ প্ল্যাটফর্ম কোনো নারীর জীবনকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনে; ঘরকে ঠিক করে দেয়; স্বামী-সন্তানের চরিত্রে প্রভাব ফেলে। আলো ছড়ানোই প্রকৃত প্রভাব; এটা আলোচনায় নয়, বরং জীবনের কাজে পরিমাপ হয়।

প্রভাবশালী হওয়া সম্মান দিয়ে নয়, বরং মানুষ ও দেশের উপকারে যে ভালো কাজ করা হয়, তার মাধ্যমেই এর সত্যিকারের মূল্য প্রকাশ পায়। আজকের প্রভাবশালী ব্যক্তি মানুষ গঠনের কাজে অংশীদার। তাই তার উচিত, মানুষের মাঝে ভালো মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়া, সঠিক পথ দেখানো, উপকারী কাজে উৎসাহ দেওয়া, গঠনমূলক মনোভাব তৈরি করা, সমাজে ভালোবাসা ও একতার শক্তি বাড়ানো; যেন তার কথা ও কাজ এমন মানুষ তৈরি করে, যারা ঈমান ও কর্ম দিয়ে পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলে।

অনেকেই আছেন যারা এই দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করছেন। তাদের উপস্থিতি মানুষকে আলো দেখায়, তাদের কন্টেন্ট মানুষকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। আল্লাহ এমন লোকদের জন্য মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করেন এবং তাদের স্মৃতি মানুষের মনে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে দয়াময় অবশ্যই তাদের জন্যে সৃষ্টি করবেন ভালোবাসা।’ (সুরা মরিয়ম : ৯৬)।

এ কথা সত্য যে, আমাদের আজকের মিডিয়া জগতে একটি বরকতময় শ্রেণি আছে, যারা তাদের প্ল্যাটফর্মকে কল্যাণের মঞ্চ বানিয়েছে। তারা ধর্ম, শিক্ষা, নৈতিকতা, স্বাস্থ্য, পরিচয়, দেশপ্রেম ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো বার্তা পৌঁছে দেয়। এরা দয়ার মনোভাব নিয়ে কাজ করে এবং এমন এক প্রজন্ম তৈরি করতে চায় যারা ধর্ম, জাতি ও দেশকে ভালোবাসে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘কথায় কে উত্তম ওই ব্যক্তি অপেক্ষা যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে ও বলে, ‘আমি তো মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’’ (সুরা ফুসসিলাত : ৩৩)।

অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, শুধু প্রভাবশালী ব্যক্তিই নয়, অনুসারীরাও প্রভাব তৈরিতে অংশীদার। তাই অনুসারীদেরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত; যেন তারা সেসব মানুষকে সমর্থন করে যারা দেশের উপকারে কাজ করে, ভালো মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়, সৎ নাগরিক গড়ে তোলে, সঠিক কাজে মানুষকে যুক্ত করে। এমন কণ্ঠকে শক্তি দিতে হবে যা মনকে নয়, চিন্তাকে আলোকিত করে; যারা শেখায় ও পথ দেখায় তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভালো কাজের পথ দেখায়, তার জন্য সেই কাজকারীর সমান সওয়াব রয়েছে।’ (মুসলিম : ৪৭৯৩)।

প্রভাব হলো এক আমানত। যার প্রতি আল্লাহ মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন তার জন্য উচিত হলো আলোর দিশারি হওয়া। কারণ আজকের যুগে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, সৎ অনুসরণযোগ্য মানুষ, যারা মানুষকে আশাবাদী করে, বিশ্বাস জাগায় এবং কাজ ও দানশীলতার দিকে উৎসাহিত করে। এই দায়িত্ব সবার। প্রত্যেকের উচিত, এমন কিছু করা যা হেদায়াতের দিকে ডাকে, আল্লাহর আনুগত্যে সহায়তা করে ও সুন্দর মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখে। একটি সত্যকথা, উপকারী কাজ ও সঠিক আচরণ ইসলামের প্রচার, উম্মাহর সুরক্ষা এবং শক্তিশালী-ঈমানদার প্রজন্ম গঠনের উপাদান। সুতরাং অভিনন্দন সেই প্রভাবশালীকে, যে সত্যবাদী! অভিনন্দন সেই অনুসারীকে, যে সঠিক মানুষকে অনুসরণ করে! শুভ সেই কথাকে, যা মানুষের জীবনকে ভালো করে তোলে! বরকতময় সেই প্ল্যাটফর্মকে, যা আলো ছড়ায়! আর আল্লাহর কাছে যে ফল পাওয়া যায়, তাই সবচেয়ে উত্তম ও চিরস্থায়ী। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর বল, তোমরা কর্ম করতে থাক; আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন এবং তাঁর রাসুল ও মুমিনরাও করবে আর অচিরেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতার কাছে, অতঃপর তিনি তোমরা যা করতে তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।’ (সুরা তওবা : ১০৫)।

(০৯-০৫-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ৩১-১০-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত