আল্লাহ মানুষকে তাঁর আনুগত্য করার জন্য সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁর সন্তুষ্টিকে অবধারিত করে। তিনি মানুষকে তাঁর অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেছেন, যা তাঁর ক্রোধকে আবশ্যক করে তোলে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তার ফলাফল পাবে। আর যে অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তার প্রতিফল দেখতে পাবে।’ (সুরা জিলযাল : ৭-৮)। তাই আল্লাহ যা আদেশ দিয়েছেন আপনারা সে ক্ষেত্রে তাঁকে ভয় করুন। তিনি যা করতে নিষেধ করেছেন ও বাধা দিয়েছেন তা থেকে বিরত থাকুন। ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২)।
পৃথিবী এক অবস্থায় স্থীর থাকে না। পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন তার ধ্বংসের ঘোষণা দিতে থাকে। দুনিয়ায় যারাই আছে সবাই ধ্বংস হবে। ‘মহামহিম তোমার রবের সত্তাই শুধু টিকে থাকবে।’ (সুরা রহমান : ২৭)।
যখন তীব্র গরমের দাবদাহে ও গ্রীষ্মের খরার মধ্য দিয়ে দিনগুলো যাচ্ছিল, ভূমি হয়ে পড়েছিল অনুর্বর, জীবজন্তু কৃশকায় হয়ে গিয়েছিল। কূপগুলোর পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। গাছপালা রুক্ষতায় আক্রান্ত হয়েছিল। পুষ্পরাজি ঝরে গিয়েছেল, ফলমূল হ্রাস পেয়েছিল। ফসল মরে গিয়েছিল। পশুদের স্তন শুষ্ক হয়েছিল। ঠিক তখনই আল্লাহ অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজের রহমতের সুসংবাদ দিয়ে বাতাস প্রেরণ করলেন। লোকরা নিরাশ হয়ে যাওয়ার পরে বৃষ্টিবর্ষণ করলেন। তার অনুগ্রহ বিস্তৃত করলেন। তিনিই তো প্রশংসনীয় অভিভাবক। আল্লাহর হুকুমে তারপর ভূমি পুনরুজ্জীবন পাচ্ছে। তা নিজের শোভা ধারণ করে সুসজ্জিত হচ্ছে। জীবন হেসে উঠছে। পৃথিবী রূপ বদলে রঙিন হচ্ছে। তাঁর পবিত্রতা পাঠ করছি যিনি মেঘমালা পাঠিয়েছেন, বীজ উৎপন্ন করেছেন। সে সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যিনি ভূমি নির্জীব হওয়ার পরে আবার তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ‘আল্লাহর রহমতের নিদর্শনের দিকে খেয়াল করে দেখ, তিনি কীভাবে নির্জীব হওয়ার পরে ভূমিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয় এভাবেই তিনি মৃতকে জীবিত করেন এবং তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।’ (সুরা রূম : ৫০)।
তিনি আরও বলেন, ‘বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোম-ল ও ভূম-ল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বর্ষণ করেছেন পানি; অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি?’ (সুরা নামল : ৬০)।
নির্জীব হওয়ার পরে বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিকে আবার পুনরুজ্জীবন দান করাটা উপদেশ ও শিক্ষার বিষয়। তা পুনরুত্থান, মৃত্যুপরবর্তী জীবন, হাশরের ময়দানে মানুষের সমবেত হওয়া ও যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, সেদিন মানুষের কবর থেকে পুনরায় উত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর অন্যতম নিদর্শন হলো, তুমি দেখতে পাবে ভূমি নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। তারপর যখন আমি তাতে বৃষ্টিবর্ষণ করি তা আন্দোলিত হয়, প্রবৃদ্ধ হয়। নিশ্চয় যিনি তা পুনরুজ্জীবিত করেছেন, তিনি অবশ্যই মৃতদের জীবিত করবেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশক্তিমান।’ (সুরা ফুসসিলাত : ৩৯)।
তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহই সে সত্তা, যিনি বাতাস প্রেরণ করেছেন, তা মেঘমালা বয়ে নিয়ে যায়। তারপর আমি তা দিয়ে মৃত ভূমি সিঞ্চন করেছি। সে পানি দ্বারা নির্জীব হওয়ার পরে ভূমিকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। পুনরুত্থান ঠিক তেমনিভাবে হবে।’ (সুরা ফাতির : ৯)।
তাই আপনারা যখন বসন্তের দেখা পাবেন তখন পুনরুত্থানের কথা স্মরণ করুন। কেননা আল্লাহ মৃতদের পুনরায় জীবন দিয়ে জাগিয়ে তুলবেন। তাদের মাটি থেকে বের করবেন, যেমন করে তিনি মাটি থেকে তাদের সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন করে তিনি মাটি থেকে উদ্ভিদ উদ্গত করেন।
আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মাটি থেকে পূর্ণরূপে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তোমাদের আবার তাতে ফিরিয়ে নেবেন এবং তোমাদের আবার বের করবেন।’ (১৭-১৮)।
শীতকাল মোমিনদের বসন্তের মৌসুম। ইবাদতকারীদের সুযোগ ও গনিমত। ইবাদতের বাগিচায় এ সময়ে তারা বিচরণ করে। আনুগত্য ও বন্দেগির ময়দানে তারা ভ্রমণ করে। আল্লাহর নৈকট্যের উদ্যানে তারা নিজেদের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে। এ মৌসুমে কষ্ট, ক্লান্তি ও ভোগান্তি কমে গিয়েছে। তাই রোজা রাখলে তাদের কষ্ট হবে না। রাতে ঘুমাতে ও জেগে ইবাদত করতে সময় কম পড়বে না। আমের ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘শীতকালে রোজা রাখা শীতল সুযোগ ও গনিমতের বিষয়।’ (আহমাদ ও তিরমিজি )।
যেসব কারণে আল্লাহ পুণ্য বৃদ্ধি করেন, ভুলত্রুটি ও পাপ-মার্জনা করেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো পবিত্রতা অর্জনে তৎপর হওয়া, যেটি ইবাদের জন্য শর্ত। ঈমানের অঙ্গ। ইসলামের রোকন বা স্তম্ভ নামাজের শর্ত। তাই শীতকালে ঠান্ডার সময় কষ্ট সহ্য করলে ও পানি ব্যবহার করে নৈকট্য লাভ করলে তা গোনাহ ও পাপ মার্জনা করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয়ের সন্ধান দেব, যা পাপ মোচন করে ও পুণ্য বৃদ্ধি করে? লোকরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল, হ্যাঁ। তিনি বললেন : কষ্ট সত্ত্বেও ভালো করে অজু করা, বেশি বেশি মসজিদে গমন করা, নামাজ শেষ হলে পরবর্তী সময়ে নামাজের অপেক্ষা করা। এটা অবিচলতা ও দ্বীনের পথের হেফাজত।’ (মুসলিম)।
শীতের ঠান্ডায় আপনারা দুর্বল, অসহায় লোকদের যতœ নিন, তাদের সহযোগিতা করুন। খাদ্য, বস্ত্র ও আচ্ছাদন খাতে তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করুন। পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এর প্রতিদান লাভের ইচ্ছা পোষণ করুন। কেননা দান-খয়রাত বিপদ দূর করে। ভালো কাজ অনিষ্টের কবল থেকে রক্ষা করে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে ভালো যা কিছুই ব্যয় কর তা তোমাদের নিজেদের জন্যই। তোমরা ভালো যা কিছুই খরচ করবে তোমাদের তা পূর্ণরূপে প্রতিদান দেওয়া হবে, তোমাদের প্রতি কোনো অবিচার না করেই।’ (সুরা বাকরা : ২৭২)।
শরিয়তের কোমলতা ও ইসলামের দূরদর্শিতার পরিচয় হলো এটা সহজ ও মহানুভবতার ধর্ম। উদ্ভূত কষ্ট ও সম্ভাব্য ক্ষতির মুহূর্তে এতে রয়েছে মানুষের ভার লাঘবের ব্যবস্থা। ‘তিনি দ্বীনের মধ্যে তোমাদের জন্য কোনো অসুবিধা রাখেননি।’ (সুরা হজ : ৭৮)। কষ্ট সহজতা নিয়ে আসে। ‘আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’ (সুরা বাকারা : ২৮৬)।
ইসলাম কষ্ট, সমস্যা ও প্রয়োজনের সময় ছাড়ের অনুমোদন দিয়েছে। যেমন, আহত, রোগী এমনকি সুস্থ ব্যক্তিও পানি ব্যবহার করলে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলে মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করতে পারবে, রোগীর কভার ও ব্যান্ডেজে মাসাহ করতে পারবে। গ্লাভস ও মোজার ওপর মাসাহ করাও শরিয়তসম্মত।
ছুটির দিনগুলো বিশ্রাম, বিরতি ও পাথেয় অর্জনের সময়। অনেক মানুষ তা কাটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতে আগ্রহী হয়। এতে সমস্যার কিছু নেই। তবে সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার করা যাবে না। অহেতুক ও অর্থহীন কাজে অতিরঞ্জন করা যাবে না। গোনাহ ও পাপ কাজে অগ্রসর হওয়া যাবে না। নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখতে হবে। মানুষকে বিরক্ত করা ও কষ্ট দেওয়া যাবে না। দৃষ্টি হেফাজত করবে। আপনারা আল্লাহর নেয়ামতরাজির শোকর আদায় করুন। তাহলে তিনি তা বৃদ্ধি করে দেবেন।
১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪২ হিজরি মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ