ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এতিমের প্রতি ভালোবাসা

মেহেদী হাসান সাকিফ
এতিমের প্রতি ভালোবাসা

ইসলামি মানবকল্যাণের ধর্ম। ইসলামি সমাজ দর্শন চায় মানব সমাজ দয়া-মায়া-মমতা ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণকামী সমাজ গঠন করতে।

ইউনিসেফ ও ইউএসএইডের ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান মতে, সমগ্র বিশ্বে প্রায় ১৫ কোটি ৩০ লাখ এতিম শিশু বাস করছে, যারা বাবা কিংবা বাবা-মা উভয়কে হারিয়েছে। বিবিসির ২০১২ সালের জরিপে বলা হয়, ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ শিশু ইরাক যুদ্ধে তাদের বাবা কিংবা বাবা-মা উভয়কেই হারিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, সিরিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে চলমান জাতিগত সংঘর্ষ ও সহিংসতায় লেবানন এবং জর্ডানে ৭০ হাজারেরও বেশি শিশু শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে, যারা শুধু তাদের পিতাকে হারিয়েছে। (দৈনিক যুগান্তর, ২১ জুন ২০১৬)।

বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে ১১ থেকে ১৫ লাখ অনাথ শিশু আছে। দেশে কর্মরত এনজিওগুলোর হিসাব মতে, এ সংখ্যা ৫৫ লাখের মতো।

এরই ধারাবাহিকতায় ইসলাম এতিম ও অসহায় শিশুর অধিকারের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন, হাদিস ও ফিকাহের কিতাবে জোর তাগিদ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, প্রশাসনিকভাবে তাদের অধিকার সংরক্ষণের ভিত্তি রচিত হয়েছে।

এতিম কে

বাংলা অভিধান অনুযায়ী মাতৃ-পিতৃহীন বালক-বালিকাকে এতিম বলে। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন শিশুকে এতিম বলা হয়, যার পিতা মারা গেছে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সে এতিম হিসেবে গণ্য হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে আর এতিম বলা হবে না। হানযালা ইবনে হুযাইম আল হানাফী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, স্বপ্নদোষ হলে কোনো ছেলে শিশু এতিম থাকে না আর ঋতুস্রাব হলে কোনো মেয়ে শিশু এতিম থাকে না। (সিলসিলা সহিহাহ, পৃষ্ঠা : ৩১৮০)। অর্থাৎ ছেলেদের স্বপ্নদোষ আর মেয়েদের ঋতুস্রাব হওয়া প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার অন্যতম আলামত। এ আলামত পাওয়া গেলে ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের এতিম বলা যাবে না। আবার যে শিশুর মা মারা গেছে আর বাবা বেঁচে আছে তাকে ইসলামের দৃষ্টিতে এতিম বলা হয় না। মা বর্তমান থাকলে অনেক সম্পত্তি থাকলেও বাবার মৃত্যুতে সেই সন্তান এতিম বলে গণ্য হবে।

আল কোরআনে এতিমের অধিকার

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিশুকালে এতিম ছিলেন। জন্মের আগেই পিতাকে হারান। তিনি সারাটি জীবন সমাজের এতিম ও অসহায়দের জন্য কাজ করেছেন।

আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে এতিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, তাদের ইসলাহ তথা সুব্যবস্থা (পুনর্বাসন) করা উত্তম...।’ (সুরা : বাকারা : ২২০)।

অন্যত্র বলেনÑ ‘পিতৃহীনদের পরীক্ষা করতে থাকো, যে পর্যন্ত না তারা বিবাহযোগ্য হয়। অতঃপর তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখলে, তাদের সম্পদ তাদের ফিরিয়ে দাও। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে ও তাড়াতাড়ি করে তা খেয়ে ফেল না। যে অভাবমুক্ত, সে যেন যা অবৈধ তা থেকে নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন, সে যেন সংগত পরিমাণে ভোগ করে। আর তোমরা যখন তাদেরকে তাদের সম্পদ সমর্পণ করবে, তখন তাদের ওপর সাক্ষী রেখ। হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা আন নিসা : ৬)।

অর্থাৎ নির্বোধ অবস্থায় সম্পদ বিনষ্টের ভয়ে এতিমদের সম্পদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে তাদের হাতে অর্পণ না করা।

আলোচ্য আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে

যারা দরিদ্র, অন্যের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারা এতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে যদি নিজের জীবিকা নির্বাহে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে তারা ন্যায়সংগতভাবে এতিমদের সম্পদ থেকে নিতে পারবে। আর যদি কেউ না নেয়, আরও উত্তম। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবমুক্ত হবে সে যেন নিজেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখে, আর যে ব্যক্তি অভাবগ্রস্ত হবে সে সংগত পরিমাণ ভোগ করবে।’ এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে এতিমের সম্পদকে কেন্দ্র করে, যদি তত্ত্বাবধায়ক দরিদ্র হয়, তাহলে তত্ত্বাবধানের বিনিময়ে ন্যায্য পরিমাণে তা থেকে ভোগ করবে। (বোখারি : ৪৫৭৫, মুসলিম : ৩০১৯)।

অপচয় করে অযথা নষ্ট করবে না এবং তারা বড় হয়ে গেলে তাদের সম্পদ নেওয়া যাবে না বা সম্পদ হস্তান্তর করে দেবে এ আশঙ্কায় বৈধতার সীমা অতিক্রম করে খাবে না। তখন তাদের প্রতি জুলুম ও অন্যায় হবে, যা আল্লাহ তায়ালা আগুন খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু যার (রা.) কে বলেছেন, হে আবু যার! আমি দেখছি তুমি দুর্বল। আর আমি তোমার জন্য তাই পছন্দ করি, যা নিজের জন্য করি। কোনো দু’জন মানুষের তুমি আমির হয়ো না এবং এতিমদের মালের দায়িত্ব গ্রহণ করো না। (মুসলিম : ১৮২৬)। (তাফসিরে ফাতহুল মাজিদ)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেনÑ ‘কাজেই আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সুরা দুহা : ৮)।

এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। এতিমের প্রতি যে সম্পদ ব্যয় করব, তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করব। এরশাদ হয়েছে, ‘তারা আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (সুরা দাহর : ৮-৯)।

হাদিসে এতিমের মর্যাদা

সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন)।’ (বোখারি : ৫৩০৪)।

অন্য হাদিসে এতিমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনÑ বিধবা, এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনও ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনও ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (মুসলিম : ৫২৯৫)।

এতিমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার একটি সহজ উপায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এ পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পতিৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮২৫২)।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি, যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অতঃপর তিনি তার অঙ্গুলির মাধ্যমে বলেন, ‘আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৬৭৯; আল-আদাবুল মুফরাদ)।

এতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর

এতিমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি ১০টি অধিকারকে অত্যধিক গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে।

১. এতিমের সম্পদ অন্যদের স্পর্শ করা নিষিদ্ধ।

২. কঠোরতা বা জোর করা নিষিদ্ধ।

৩. মর্যাদার অধিকার।

৪. রূঢ়তা ও দুর্ব্যবহার নিষিদ্ধ।

৫. খাদ্যের অধিকার।

৬. আশ্রয় প্রদানের অধিকার।

৭. বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তরাধিকার সংরক্ষণ।

৮. ইহসান বা ভালো ব্যবহারের অধিকার।

৯. ইনসাফ বা ন্যায়সঙ্গত বিচারের অধিকার।

১০. মালে ফাঈ বা যে মাল কাফেরদের সঙ্গে বিনাযুদ্ধে মুসলিমদের হস্তগত হয় (যেমন : খারাজ, জিযিয়া ইত্যাদি), তার ওপর অধিকার।

এতিমদের প্রতি আমাদের করণীয়

আমাদের দেশে অনেক অনাথ এতিম শিশু পথেঘাটে অনাদর অবেহেলায় বেড়ে ওঠে। তাদের মনে এজন্য প্রচ- ক্ষোভ কাজ করে। সবাই খাবার পেলেও আমরা পাই না। সবাই পোশাক পেলেও আমরা পাই না।

এজন্য খুব সহজেই নিজেদের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা খুব অস্বাভাবিক নয়। এজন্য আমাদের তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মানসিকভাবে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত না হয়। পথশিশুরা খুব সহজেই মাদকের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে যেন তাদের ফিরিয়ে আনা যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান মানুষ রয়েছেন। এসব মানুষের সহায়তায় তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। যেমনÑ বিদ্যুৎ সংক্রান্ত, এমব্রয়ডারি এবং কাপড়ে জরি ও চুমকি বসানো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত সাইনবোর্ড এবং পতাকা বা বিজ্ঞপ্তি লেখা, কাপড়ে ব্লক ও প্রিন্ট করা, কাপড় সেলাই ও তৈরি, কাঠের কাজ, চামড়া শিল্প ইত্যাদি।

এছাড়া প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের বিনাসুদে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতিমরা খুবই অসহায়। তারা আমাদেরই ভাইবোন।

এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো দেশের পক্ষে সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। সর্বোপরি দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতে প্রিয় নবীজির সঙ্গে একত্রে জান্নাত লাভ করতে হলে আমাদের আশপাশের সব অসহায়, অনাথ, এতিম শিশুর প্রতি সাধ্য মতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত