ঢাকা শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জালেম শাসকের ঈমানদার স্ত্রী বিবি আছিয়া (আ.)

আবুল হাসান মুহা. শাবাব
জালেম শাসকের ঈমানদার স্ত্রী বিবি আছিয়া (আ.)

অবিচলতার এক অনুপম আদর্শ গল্প। ধরিত্রীর রমণীকুলের এক সম্মানিত নারীর গল্প। তিনি আল্লাহর প্রিয় বান্দি আছিয়া (আ.)। তখনকার যুগের সবচেয়ে অত্যাচারী বাদশাহ, আল্লাহর দুশমন ফেরাউনের স্ত্রী। রাজপ্রসাদে দাস-দাসীদের সেবায় সুখের গতিতেই চলছিল তার জীবন। মুকুটবিশিষ্ট সম্রাজ্ঞীর পদে ছিলেন অভিসিক্ত। ফেরাউনের সাম্রাজ্য আর ক্ষমতার অংশীদারিত্ব তার চরিত্রকে করতে পারেনি কলুষিত। হননি সামান্যও প্রভাবিত। বরং হকের ওপর ছিলেন অটল-অবিচল। কারণ আল্লাহ তাকে ঈমানি আলো দিয়ে পথ দেখিয়েছেন। তিনিই ছিলেন অত্যাচারী ফেরাউনের কবলে থেকেও মুসা (আ.) এর বেঁচে থাকার উসিলা।

ফেরাউনের সৈন্যরা তাকে সাগর থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলে আছিয়া (আ.) দেখেন নুরের জ্যোতিতে জ্বলজ্বল করছে একটি চেহারা। আল্লাহ কোরআনে তুলে ধরেছেন সেই ঘটনা : ‘ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোনো খবর ছিল না।’ (সুরা কাসাস : ৯)।

পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনা পরম্পরা শেষে মুসা (আ.) নবুয়ত লাভ করেন। তারপর একত্ববাদের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। তার এ দাওয়াতে রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা তার ওপর ঈমান আনে। এ পর্যায়ে ফেরাউন ইসলাম ও রাজ পরিচারিকার ঈমান গ্রহণের কথা জানতে পারল। রাজ পরিচারিকা তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলল : ‘আমার আর তোমার রব একমাত্র আল্লাহ।’ ফেরাউন একথা শুনে তাকে তার বাচ্চাকাচ্চাসহ আগুনে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিল।

কিছুদিন পর ফেরাউন তার স্ত্রী আছিয়া (আ.) এর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ পেল। সে রাগে আর ক্ষোভে তাকে কঠিন শাস্তির প্রতিজ্ঞা করল। এ অহংকারী নিজেকে রব আর মানুষের প্রতিপালক মনে করত। সে এই নিকৃষ্ট ধারণার বশীভূত হয়ে বলত : ‘আমিই তোমাদের সেরা রব।’ (সুরা নাজিয়াত : ২৪)। নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ সবধরনের অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। তিনি একক। চিরন্তন এক সত্তা।

তারপর ফেরাউন সব মানুষকে একত্রিত করে স্ত্রী আছিয়া (আ.) সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাইল। সবাই তার প্রশংসা করল। তখন ফেরাউন বলল : সে তো আমাকে ছেড়ে অন্য রবের উপাসনা করে। তারা বলল : তাহলে তাকে হত্যা করে ফেলেন। মুহূর্তেই পরিবর্তন করে ফেলল তারা নিজেদের মতামত। আশ্চর্য তাদের এ অসুস্থ হৃদয়! আশ্চর্য তাদের দ্বৈতনীতি!

ফেরাউন তার সৈন্য-সামন্তকে আদেশ দিলে তারা বিবি আছিয়াকে শক্তভাবে হাত-পা বেঁধে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে ফেলে রাখে। ফেরাউন তখন পিঠে বড় একটি পাথরখ- রাখতে আদেশ করে। গতকাল যিনি ছিলেন সম্মানের মুকুট পরিহিতা সম্রাজ্ঞী। জীবনযাপনে সুখী। যার ছিল হাজারো গোলাম আর দাসি। আজ তিনি লাঞ্ছিত আর অপমানিত। পিঠে পাথরখ- রাখার আগে তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘মালিক! জান্নাতে তোমার কাছে আমার জন্য একটি ঘর বানিয়ে দাও!’ (সুরা তাহরিম : ১১)।

সেদিন অপমান আর লাঞ্ছনার কোনো পরোয়া ছিল না তার। কামনা ছিল একটাই; প্রভুর সান্নিধ্য। ওরা তার পিঠে পাথর রাখার আগেই নিজ চোখে জান্নাতে তার জন্য নির্মিত ঘর দেখে দেখে প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। আর ওরা পাথর নিক্ষেপ করে প্রাণহীন এক নিথর দেহে।

তার নিখাদ ঈমান আর প্রভুপ্রেমের এ অনুপম ঘটনা আল কোরআনে আল্লাহ তুলে ধরেছেন অত্যন্ত হৃদয়ছোঁয়া ভঙ্গিতে : ‘আল্লাহ মোমিনদের জন্য ফেরাউন-পতœীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন।’ সে বলল : হে আমার পালনকর্তা! আপনার কাছে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহনির্মাণ করুন আর আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে মুক্তি দিন জালেম সম্প্রদায় থেকে।’ (সুরা তাহরিম : ১১)।

আছিয়া (আ.) কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হয়েও অবিচলতার অনুপম দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অবশেষে সফলতার মুখ দেখলেন। তিনি সত্যের আলো পেয়েছিলেন। তাই একক সত্তা আল্লাহকে নিজের রব হিসেবে বিশ্বাস রেখেই তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তিনি আল্লাহবিশ্বাসী ছিলেন। তার স্বামীর কুফর তার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বরং তিনি সত্য জেনে তার ওপর অটল থেকেছেন।

আল্লাহ তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরে সত্যের ওপর টিকে থাকার অনুপম এক উপমা বানিয়েছেন। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও তার একক সত্তার ওপর ঈমান নিয়ে টিকে থাকার আদর্শ দৃষ্টান্ত হলেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে তাকে জান্নাতে একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন : ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকেই কামেল হয়েছে, আর মহিলাদের মধ্যে শুধু আছিয়া আর মারিয়াম বিনতে ইমরান। আর আয়েশার (রা.) মর্যাদা তো এমন সারিদের মর্যাদা অন্যসব খাবারের ওপর যেমন।’

মহীয়সী রমণী আছিয়া (আ.) আল্লাহর প্রদত্ত পুরস্কারের প্রতি বিবেচনা করলে দেখবেন সত্যের ওপর অটল-অবিচল ছিলেন এমন এক সময়, যখন তিনি ছিলেন উপভোগ্য সব বস্তুর মালিক। অথচ আমরা অবহেলা আর অমনোযোগে আল্লাহর কত ফরজ বিধান ছেড়ে দিই। ঈমানের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ নেওয়া তো দূরের কথা, ঈমানের সাধারণ পরিচয়ও দিতে পারি না অনেক ক্ষেত্রেই।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

মাদ্রাসা আনাস বিন মালিক (রা.) সাইনবোর্ড, যাত্রাবাড়ী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত