আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করার মর্যাদা অপরিসীম। যিনি ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে শহীদ হতে চান, তাকে আল্লাহ তায়ালা সীমাহীন সম্মানিত করেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জনে প্রতিযোগিতা করতেন। ছোট ছোট সাহাবারাও বিধর্মীদের সঙ্গে লড়াইয়ে শাহাদাতের নেশায় পাগল হয়ে যেতেন। নবী করিম (সা.) তাদের বয়স স্বল্পতার কারণে বাড়িতে রেখে যেতেন। স্বয়ং নবী করিম (সা.) শহীদের মর্যাদা লাভ করতে তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁকে কসম করে বলছি, কামনা করি আল্লাহর রাস্তায় আমি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে লড়াই করে আবার শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে যুদ্ধ করে আবার শহীদ হই। আবার জীবিত হয়ে যুদ্ধ করে আবার শহীদ হই। এরপর আবার জীবিত হই।’ (বোখারি : ৭২২৭)। অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘শহীদদের রুহগুলো সবুজ পাখির পেটে থাকবে। তাদের জন্য আরশের সঙ্গে ঝুলানো মোমবাতি থাকবে, জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা তারা বিচরণ করবে।’ (মুসলিম : ১৮৮৭)।
যে ব্যক্তি কোনো ধরনের লোভ বা দুনিয়ার কোনো স্বার্থ উদ্ধারের নিয়ত ব্যতীত একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার লক্ষ্যে ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন করার মানসে লড়াই করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, তাকেই শহীদ বলা হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কেউ গনিমতের মালের জন্য যুদ্ধ করে, কেউ বিখ্যাত হওয়ার নিয়তে লড়াই করে, কেউ পদমর্যাদার লক্ষ্যে যুদ্ধ করে, তাহলে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করে কে? বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার নিয়তে ইসলামবিরোধীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সেই আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করে।’ (বোখারি : ৩১২৬)।
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, মাতৃগর্ভে মারা যাওয়া শিশু শহীদ, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ।’ (মুসলিম : ১৯১৫)। তবে এ ধরনের শহীদকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘হুকমি শহীদ’ বলা হয়। আর ‘হাকিকি শহীদ’ হলেন যারা ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে লড়াইয়ে বা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে শহীদের অসংখ্য ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের জন্য বিশেষ বিশেষ সম্মান ও পুরস্কারের কথা ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ মোমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য জান্নাত আছে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। ফলে হত্যা করে ও নিহতও হয়।’ (সুরা তাওবা : ১১১)।
শহীদরা আল্লাহর কাছে জীবিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের কখনোই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত। তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে রিজিক দেওয়া হয়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬৯)।
সাহাবি হারিসা (রা.) বদর সমরে শহীদ হন। তার মাতা নবী করিম (সা.) এর কাছে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি কি হারিসা সম্পর্কে আমাকে কোনো সংবাদ দেবেন না? যদি সে জান্নাতে থাকে, তাহলে আমি ধৈর্য ধারণ করব। নতুবা তার জন্য ক্রন্দন করব। নবী করিম (সা.) বললেন, হে হারিসার মাতা! তার রুহ জান্নাতে রয়েছে। তাকে শ্রেষ্ঠ জান্নাত দান করা হয়েছে।’ (বোখারি : ২৮০৯)।
শহীদদের সাতটি বিশেষ পুরস্কার, যা অন্য কারও নেই
এক. ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত শহীদের ক্ষতস্থান থেকে রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তায়ালা শহীদের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন।
দুই. জান্নাতে তার স্থান নির্ধারণ করে দেন।
তিন. আল্লাহ তায়ালা শহীদকে কবরের সব ধরনের আজাব থেকে পরিপূর্ণ মুক্তিদান করেন।
চার. ‘মহাভীতি’ শহীদদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবে না। মুফাসসিররা ‘মহাভীতির’ ভিন্ন ভিন্ন তাফসির করেছেন। কেউ বলেছেন, মহাভীতি দ্বারা উদ্দেশ্য দ্বিতীয়বার সিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া। কেউ বলেছেন, মহাভীতি দ্বারা উদ্দেশ্য মৃত্যুযন্ত্রণা। কেউ বলেছেন, মহাভীতি দ্বারা উদ্দেশ্য ওই সময়, যখন জাহান্নামের উপযুক্ত ব্যক্তিদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
পাঁচ. শহীদের মাথায় সবচেয়ে দামি ইয়াকুত পাথরে সজ্জিত মুকুট পরানো হবে। এটা হবে সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মুুকুট। ইয়াকুত পাথর অত্যন্ত স্বচ্ছ, মজবুত ও মর্যাদার প্রতীক।
ছয়. ৭২ জন ‘হুর ইনের’ সঙ্গে একজন শহীদের বিবাহ দেওয়া হবে। ‘হুর’ বলা হয়, শুভ্র-কৃষ্ণবর্ণ মিশ্রিত ডোরাকাটা চক্ষুবিশিষ্ট। ‘ইন’ বলা হয়, ডাগর চক্ষুকে। মোটকথা আকর্ষণীয় চোখ বিশিষ্টকে ‘হুরুন ইন’ বলা হয়।
সাত. শহীদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ৭০ জনের জন্য শহীদকে সুপারিশ করার অধিকার দান করা হবে। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারেন। (হাইসামিকৃত মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৫/২৯৬)।
দু’জন বিখ্যাত শহীদ সাহাবি
ক. হানজালা ইবনে আবি আমের (রা.)। বাসররাত কাটানোর সময় জিহাদের ডাক আসে। ওহুদের ময়দানে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যান। যুদ্ধ শেষে শহীদদের সারিতে তাকে পাওয়া যায়। তিনি ফরজ গোসল করে বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। এ জন্য ফেরেশতারা তাকে গোসল করান! আহ! কী গৌরবের কথা! ফলে তার উপাধী হয়ে যায় ‘গসিলুল মালাইকা’ তথা ফেরেশতা কর্তৃক গোসলের সম্মান লাভকারী ব্যক্তি।
খ. আমর ইবনে জামুহ (রা.)। ৬০ বছরের বৃদ্ধ সাহাবি। তার চারজন ছেলেই নবী (সা.) এর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ওহুদ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলে তিনিও যুদ্ধে যেতে ব্যগ্রতা প্রকাশ করেন। কিন্তু সন্তানরা তাকে বয়সজনিত কারণ দেখিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি সরাসরি নবী (সা.) এর কাছে গিয়ে ঘটনা বললে নবী (সা.) তার সন্তানদের বললেন, ‘তোমরা তাকে বাধা দিচ্ছ কেন? হয়তো আল্লাহ তায়ালা তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন।’ ফলে তিনি যুদ্ধে শরিক হলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে ওহুদ যুদ্ধেই শাহাদাতের পরম সৌভাগ্য দান করেন। (সিরাত গ্রন্থগুলো)।
লেখক : খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ