হাফসা (রা.)। বাবা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। মা জয়নাব বিনতে মাজউন। নবীজি (সা.) এর নবুয়তের পাঁচ বছর আগে মক্কার কোরাইশদের বাইতুল্লাহ নির্মাণ সময়কালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর সবচেয়ে বড় সন্তান। বর্ণনায় পাওয়া যায়, তিনি বয়সে ভাই আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) এর বড় ছিলেন। তার জন্ম ঠিক হিজরতের ১৮ বছর আগে। (মাসানিদু উম্মাহাতিল মোমিনিন : পৃষ্ঠা : ১০৩)।
তিনি প্রথমে খোনাইস ইবনে হোজাফা সাহমিকে বিয়ে করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। স্বামী খোনাইস মুসলমানদের প্রথম হিজরতের সময় আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। প্রথম সে হিজরতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১২ জন পুরুষ এবং চারজন নারী। সবার নেতৃত্বে ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমান ইবনে আফফান (রা.)। স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন নবীকন্যা রোকাইয়্যাহ (রা.)।
তারপর খোনাইস হাফসাকে (রা.) সঙ্গে করে মদিনা মোনাওরায় হিজরত করেন। তিনি রাসুলের (সা.) সঙ্গে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অথচ বনু সাহমের আর কেউ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। পরবর্তী সময়ে বদরের আঘাতে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। (আস-সিরাতুল হালাবিয়্যাহ : ৩/৩১৪)।
স্বামীর ইন্তেকালের পর ওমর ইবনে খাত্তাব কন্যা হাফসার (রা.) প্রতি খুবই বগলিত হন এবং উপযুক্ত স্বামীর সন্ধান করতে থাকেন। তিনি বলেন, আমি ওসমান ইবনে আফফানের (রা.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার কাছে হাফসার (রা.) বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে বলি, চাইলে আমি আপনার কাছে ওমর কন্যা হাফসাকে বিয়ে দিতে পারি। ওসমান (রা.) প্রস্তাবের জবাবে বলেন, বিষয়টি ভেবে দেখব। কয়েক রাত পর ওসমান (রা.) আমার সাক্ষাতে বলেন, মনে হচ্ছে, আমি তাকে এ মুহূর্তে বিয়ে করতে পারব না। ওমর (রা.) বলেন, তারপর আমি আবু বকর (রা.) এর সঙ্গে দেখা করে বললাম, রাজি থাকলে আমি আপনার কাছে ওমর নন্দিনী হাফসাকে (রা.) বিয়ে দিতে চাই। আবু বকর (রা.) চুপ থাকেন। তিনি আমাকে কোনো সাড়া দেননি। আমি তখন কিছুটা আহত হই। কয়েক রাত পর রাসুল (সা.) হাফসার (রা.) জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। আমি তাঁর কাছেই বিয়ে দিই।
পরে আবু বকর (রা.) আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, হাফসার বিয়ের প্রস্তাবে কিছু না জানানোতে হয়তো আমার সঙ্গে রাগ করেছেন? ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। আবু বকর (রা.) তখন বলেন, আমি জানতে পারি, রাসুল (সা.) তার ব্যাপারে আলোচনা করছেন। এজন্য আমি এ বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দিইনি এবং রাসুল (সা.) এর গোপন বিষয়টি ফাঁস করাও উপযুক্ত মনে হয়নি। রাসুল (সা.) হাফসাকে বিয়ে না করলে অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতাম। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ : ১১/১৮৪)।
রাসুল (সা.) তাকে উহুদ যুদ্ধের ৩০ মাস আগে শাবান মাসে বিয়ে করেন। কারও কারও মতে হিজরতের তৃতীয় বছরে বিয়েটি সংঘঠিত হয়।
তিনি ছিলেন অত্যধিক আত্মমর্যাদাশীল। নবীজি (সা.) এর অন্য স্ত্রীদের সঙ্গে নারীসুলভ গৌরব ও ঈর্ষা দেখাতেন। বিশেষত যদি তার আরও সতীন থাকে। সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, সাফিয়্যা (রা.) জানতে পারেন, হাফসা তাকে ‘ইহুদিকন্যা’ বলে কটাক্ষ করেছেন। এতে সাফিয়্যা (রা.) অনেক কষ্ট পান। নবী (সা.) এসে তাঁকে কাঁদতে দেখেন। জিজ্ঞেস করেন, কাঁদছ কেন? সাফিয়্যা (রা.) বলেন, হাফসা (রা.) আমাকে ইহুদিকন্যা বলেছেন। নবী (সা.) বললেন, তুমি হলে নবীকন্যা। তোমার চাচা নবী এবং একজন মহান নবীর স্ত্রী। কিসে সে তোমার ওপর গর্ব করবে? তারপর নবী (সা.) হাফসাকে (রা.) লক্ষ্য করে বললেন, হে হাফসা, আল্লাহকে ভয় কর।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৪)।
স্বামীর নৈকট্য লাভের প্রতিযোগিতায় তিনি আয়েশা (রা.) এর প্রতিও ঈর্ষা করতেন। আয়েশা (রা.) নিজেই বলেন, নবী (সা.) সফরে বের হলে স্ত্রীদের মধ্যে কাকে সঙ্গে নেবেন সে ব্যাপারে লটারি দিতেন। লটারি আয়েশা (রা.) ও হাফসার (রা.) দিকে ছুটে গেল। আর নবী (সা.) রাতে সফরে বের হলে আমাকে সঙ্গে নিতেন। গল্প করতে করতে পথ চলতেন। তখন হাফসা (রা.) এসে বললেন, তুমি কি আজ রাতে আমার বাহনে সওয়ার হবে, আর আমি তোমার বাহনে সওয়ার হই। তুমিও দেখলে, আমিও দেখলাম? আয়েশা (রা.) বললেন, ঠিক আছে। নবী (সা.) আয়েশা (রা.) এর উটের কাছে গিয়ে দেখলেন হাফসা (রা.)। নবী (সা.) সালাম দিলেন। তারপর সওয়ারি থেকে অবতরণ করা পর্যন্ত পথ চললেন। এদিকে আয়েশা (রা.) নবীজিকে (সা.) অনেক মিস করলেন। যখন তারা অবতরণ করলেন, ‘ইযখির’ ঘাসে হাফসার (রা.) পা আটকে যায়, তিনি বলতে থাকেন, ওহ আল্লাহ! বিচ্ছু বা সাপ আমাকে কামড় দেওয়ার জন্য ছেড়ে দেন, কিন্তু তাকে (নবীজিকে) আমি কিছুই বলতে পারব না।’ (বোখারি : ৪৯১৩)।
আরেকবারের ঘটনা। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) এক স্ত্রীর কাছে ছিলেন। অতঃপর অন্য একজন স্ত্রীর ঘর থেকে একটা পাত্রে করে খাবার পাঠানো হলো।
হাফসা (রা.) আত্মমর্যাদায় বিভোর হয়ে খাদেমের হাতে মেরে বসেন। এতে পাত্র তার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। নবী (সা.) ভাঙা পাত্রের টুকরাগুলো উঠান এবং পড়ে যাওয়া খাবারও পাত্রে ওঠাতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, ‘তোমাদের মা ঈর্ষান্বিত হয়েছেন।’ অতঃপর তিনি খাদেমকে দিয়ে অন্য ভালো একটা পাত্র পাঠিয়ে দেন এবং ভেঙে যাওয়া পাত্রটি যে ঘরে ভেঙেছে, সেখানে রেখে দেন।’ (বোখারি : ৪৯২৭)।
নবী (সা.) তাঁকে শিক্ষাদানের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। শেফা বিনতে আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার কাছে রাসুল (সা.) এলেন, আমি তখন হাফসার (রা.) কাছে বসা। রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, তুমি হাফসাকে (রা.) যেভাবে লেখা শেখাও, সেভাবে আমাকে এ ‘নামলা’ (ভ্রƒণের ক্ষত রোগ) এর ঝাঁড়ফুক শেখাবে না?’ (আবু দাউদ : ৩৮৮৭)। এ হাদিসে হাফসা (রা.) এর লেখা শেখা বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ সেকালে কত কঠিন ছিল বিষয়টি। তাই তো তিনি ইসলামের প্রথম দিকের বড় ফকিহ হয়ে উঠেছিলেন।
নবী (সা.) তাঁকে একবার (এক) তালাক দিয়েছিলেন। বাবা ওমর ইবনে খাত্তাব জানতে পেরে মাথার ওপর মাটি নিক্ষেপ করে আক্ষেপ করতে করতে বললেন, আজকের পর নিজের জীবন এবং কন্যা থেকে আল্লাহর কি পরওয়া! কায়েস ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) হাফসা বিনতে ওমরকে (রা.) তালাক (রজঈ) দিলেন। অতঃপর তার মামা মাজউন পুত্রদ্বয় কোদামা ও ওসমান এলেন। হাফসা (রা.) কেঁদে কেঁদে বললেন, আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে বিদ্বেষবশত তালাক দেননি। তারপর নবী (সা.) এসে বললেন, জিবরাইল (আ.) আমাকে বললেন, হাফসাকে ফিরিয়ে নেন। কেননা তিনি অনেক রোজাদার ও অনেক দীর্ঘ নামাজ আদায়কারী। আর তিনি জান্নাতে আপনার স্ত্রী হিসেবে থাকবেন।’ (আল আসানিদুল আশারা : ৭/২৫১)।
নবী (সা.) এর ইন্তেকালের পর আপন ঘরেই থাকতেন। প্রয়োজন ছাড়া কখনও বাইরে বের হতেন না। তিনি আর আয়েশা (রা.) ছিলেন এক শক্তি। আয়েশা (রা.) বসরায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে হাফসা (রা.)ও তাঁর সঙ্গে বের হতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে ওমর যেতে বাধা দিলেন।
তিনি ছিলেন বিশুদ্ধভাষী। বাগ্মী। হাদিস বর্ণনাকরী বড় মুহাদ্দিস। তিনি রাসুল (সা.) এবং তাঁর বাবা ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে সর্বমোট ৬০টি হাদিস বর্ণনা করেন। এর মধ্যে তিনটি হাদিস বোখারি ও মুসলিম উভয়টিতে রয়েছে। মুসলিমে স্বতন্ত্রভাবে ছয়টি হাদিস রয়েছে। সাহাবি ও তাবেয়িদের বড় একটি দল তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আপন ভাই আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, পুত্র হামযা, পুত্রবধূ সাফিয়্যা বিনতে আবু উবাইদ, হারেসা বিনতে ওয়াহাব, মুত্তালিব ইবনে আবু ওবায়দা, উম্মে মুবাশ্শির আনসারি, আবদুর রহমান ইবনে হারেস ইবনে হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা এবং মুসায়্যিব ইবনে রাফে প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মুসনাদে বাকি ইবনে মাখলাদে এ ধরনের ৬০টি হাদিস উল্লেখ আছে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/২২৭-২২৮; আলাম, যিরিকলি : ২/২৬৫)।
তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ যা সংরক্ষিত ছিল তা হলো পবিত্র কোরআনের ওই কপি, যা ওমর ইবনে খাত্তাবের পরামর্শে আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে লিখিত হয়েছে। ওসমান ইবনে আফফান (রা.) তাঁর কাছে রক্ষিত কপির ওপর নির্ভর করেই কোরআনে কারিমকে এক কপিতে নিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বর্ণনানুসারে তিনি ৪৫ হিজরির শাবান মাসে ইন্তেকাল করেন। কারও কারও মতে ওসমান (রা.) এর শাসনামলে ২৭ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। আবার কারও কারও মতে আফ্রিকা বিজয়ের বছর তিনি ইন্তেকাল করেন।
(কিসসাতুল ইসলাম অবলম্বনে)