যার ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মুসলমানরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, প্রকাশ্যে কাবা শরিফের সামনে নামাজ আদায়ের সুযোগ পায়। যিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে অর্ধ পৃথিবী শাসন করে, শাসকদের জন্য উত্তম আদর্শ হয়ে আছেন তিনি হলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, ফারুকে আজম হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)।
ইসলাম গ্রহণ
ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা দোয়া করলেন : ‘হে আল্লাহ! আবু জাহেল কিংবা ওমর ইবনুল খাত্তাব- এই দুজনের মধ্যে তোমার কাছে যে বেশি প্রিয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে মজবুত করো ও মর্যাদা দান করো।’ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘ওই দুজনের মধ্যে ওমর (রা.)-ই আল্লাহর প্রিয় হিসেবে আবির্ভূত হন।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৬৮১)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যেদিন ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন, সেদিন হতে আমরা অত্যন্ত মর্যাদাশীল হয়ে আসছি।’ (সহিহ বোখারি : ৩৬৮৪)।
পরিপূর্ণ ঈমানদার
আবদুল্লাহ ইবনু হিশাম (রহ.) বলেন, আমরা একদা নবী (সা.) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন ওমর ইবনু খাত্তাব (রা.) এর হাত ধরেছিলেন। ওমর (রা.) তাকে বললেন : ইয়া রাসুলুলাল্লাহ (সা.)! আমার প্রাণ ব্যতীত আপনি আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। তখন নবী (সা.) বললেন : না, ওই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! এমন কি তোমার কাছে তোমার প্রাণের চেয়েও আমাকে অধিক প্রিয় হতে হবে। তখন ওমর (রা.) বললেন : এখন, আল্লাহর কসম! আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। নবী (সা.) বললেন : হে ওমর! এখন (তোমার ঈমান পূর্ণ হয়েছে)।’ (সহিহ বোখারি : ৬৬৩২)।
পরিপূর্ণ আমলদার
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আমি এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) উভয়ে মসজিদে নববী থেকে বের হচ্ছিলাম। তখন মসজিদের দরজায় এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘তুমি কেয়ামতের জন্য কী পাথেয় সঞ্চয় করেছ?’ বর্ণনাকারী বলেন, তখন লোকটি চুপ হয়ে গেল। এরপর সে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! আমি তো সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নামাজ, রোজা ও সদকাণ্ডখয়রাত সঞ্চয় করিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) কে ভালবাসি। তিনি বললেন : ‘তুমি তার সঙ্গেই থাকবে যাকে তুমি ভালোবাস।’
আনাস (রা.) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পরে কোনো কিছুতে আমরা এত বেশি খুশি হয়নি, যতটা নবী (সা.) এর বাণী : ‘তুমি তার সঙ্গেই (থাকবে) যাকে তুমি ভালোবাস’ দ্বারা আনন্দ লাভ করেছি। আনাস (রা.) বলেন, আমি আল্লাহ, তাঁর রাসুল, আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) কে ভালবাসি। সুতরাং আমি আশা করি যে, কেয়ামত দিবসে আমি তাদের সঙ্গে থাকব, যদিও আমি তাদের মতো আমল করতে পারিনি। (মুসলিম ৬৬০৬, ৬৬০৭, ৬৬০৮), (বোখারি : ৩৬৮৮)।
উমরা (রা.) আবু বকর (রা.) এর ওফাতের পর খলিফার আসনে অধিষ্ঠিত হন এবং বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতার সঙ্গে অর্ধ পৃথিবী শাসন করেন। হাদিসে পাকে এসেছে ওমর (রা.) হচ্ছেন ফিতনাগুলো আগমনের সামনে দরজাস্বরুপ। যখনই এ দরজা ভেঙে যাবে অর্থাৎ ওমর (রা.) দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করবেন, ফিতনাগুলো প্রবেশ করতে থাকবে। (সহিহ বোখারি : ৭০৯৬)।
শ্রেষ্ঠত্ব
আমিরুল মুমিনিন আলী (রা.) এর ছেলে মুহাম্মাদ ইবনু হানাফিয়া (রা.) বলেন, আমি আমার পিতা আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সা.) এর পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, আবু বকর (রা.)। আমি বললাম, অতঃপর কে? তিনি বললেন, ওমর (রা.)। (সহিহ বোখারি : ৩৬৭১)।
ইবনু ওমর (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে সাহাবীদের পারস্পরিক মর্যাদা নির্ণয় করতাম। আমরা সর্বাপেক্ষা মর্যাদা দিতাম আবু বকর (রা.)-কে তারপর ওমর ইবনু খাত্তাব (রা.)-কে। (সহিহ বোখারি : ৩৬৫৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : (জান্নাতে) সর্বোচ্চ সম্মাননায় আসীন লোকদের অবশ্যই তাদের নিচের মর্যাদার লোকেরা দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আসমানের দিগন্তে উদিত তারকা দেখতে পাও। আবু বকর ও ওমর তাদেরই দলভুক্ত, বরং আরও বেশি রহমত ও মর্যাদার অধিকারী। (সুনানে তিরমিজি : ৩৬৫৮; সুনানে ইবনে মাজাহ : ৯৬)।
তাঁর শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী
আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, (একবার) নবী (সা.), আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), উসমান (রা.) উহুদ পাহাড়ে আরোহণ করেন। পাহাড়টি নড়ে উঠল। রাসুলুল্লাহ (সা.) (পা দ্বারা আঘাত করে) বললেন, ‘হে উহুদ! থামো তোমার ওপর একজন নবী, একজন সিদ্দীক ও দু’জন শহীদ রয়েছেন।’ (সহিহ বোখারি : ৩৬৭৫)।
যে বিষয়টি তাঁর কাছে অনেক বড় ছিল
ফজরের নামাজে ইমামতিকালীন আবু লুলু নামে এক অমুসলিম গোলাম ওমর (রা.) কে আঘাত করে। আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এর ইমামতিতে নামাজ সম্পন্ন করা হয়। আহত অবস্থায় ওমর (রা.) কে বাসায় আনা হয়। লোকজনও আসতে শুরু করে। সবাই তার প্রশংসা করতে লাগল। তখন যুবক বয়সি একজন এসে বলল, হে আমিরুল মু’মিনীন। আপনার জন্য আল্লাহর সুসংবাদ রয়েছে; আপনি তা গ্রহণ করুন। আপনি নবী (সা.) এর সাহচর্য গ্রহণ করেছেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগেই আপনি তা গ্রহণ করেছেন, যে সম্পর্কে আপনি নিজেই অবগত আছেন অতঃপর আপনি খলিফা হয়ে ন্যায়বিচার করেছেন।
অতপর তিনি তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ (রা.) কে বললেন, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.)-এর খিদমতে যাও এবং বলো ওমর আপনাকে সালাম পাঠিয়েছে। ‘আমীরুল মুমিনীন’ শব্দটি বলবে না। কেননা, এখন আমি মোমিনদের আমীর নই। তাকে বলো ওমর ইবনে খাত্তাব তার সাথিদ্বয়ের পাশে দাফন হওয়ার অনুমতি চাচ্ছেন। ইবনে ওমর (রা.) আয়েশা (রা.)-এর খিদমতে গিয়ে সালাম জানিয়ে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তিনি বললেন, প্রবেশ কর, তিনি দেখলেন, আয়েশাহ (রা.) বসে বসে কাঁদছেন। তিনি গিয়ে বললেন, ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের পার্শ্বে দাফন হওয়ার জন্য আপনার অনুমতি চেয়েছেন। আয়েশা (রা.) বললেন, তা আমার আকাক্সক্ষা ছিল। কিন্তু আজ আমি এ ব্যাপারে আমার উপরে তাকে প্রাধান্য দান করছি।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.), যখন ফিরে আসছেন তখন বলা হলো- এই যে আবদুল্লাহ ফিরে আসছে। তিনি বললেন, আমাকে উঠিয়ে বসাও। তখন এক ব্যক্তি তাকে ঠেস দিয়ে বসিয়ে ধরে রাখলেন। ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কী সংবাদ? তিনি বললেন, আমীরুল মু’মিনীন, আপনি যা কামনা করেছেন, তাই হয়েছে, তিনি অনুমতি দিয়েছেন। ওমর (রা.) বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। এর চেয়ে বড় কোনো বিষয় আমার কাছে ছিল না। যখন আমার মৃত্যু হয়ে যাবে, তখন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, ওমর ইবনু খাত্তাব (রা.) আপনার অনুমতি চাচ্ছেন। যদি তিনি অনুমতি দেন, তবে আমাকে প্রবেশ করাবে আর যদি তিনি অনুমতি না দেন, তবে আমাকে সাধারণ মুসলিমদের গোরস্থানে নিয়ে যাবে। (সহিহ বোখারি : ৩৭০০)।
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) প্রায়ই এই বলে দোয়া করতেন, ‘ধন্য আমায় করো প্রভু তোমার পথের শাহাদাতে, মৃত্যু হয় গো যেন তোমার রাসুলের মদিনাতে।’ (সহিহ বোখারি : ১৮৯০)।
দাফন
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ওমর (রা.)-এর লাশ (মোবারক) খাটের ওপর রাখা হলো। খাটটি কাঁধে তুলে নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লোকজন তা ঘিরে দোয়া পাঠ করছিল। আমিও তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। হঠাৎ একজন আমার কাঁধে হাত রাখায় আমি চমকে উঠলাম। চেয়ে দেখলাম, তিনি আলী (রা.)। তিনি ওমর (রা.)-এর জন্য আল্লাহর অশেষ রহমতের দোয়া করছিলেন। তিনি বলছিলেন, হে ওমর! আমার জন্য আপনার চেয়ে বেশি প্রিয় এমন কোনো ব্যক্তি আপনি রেখে যাননি, যার কালের অনুসরণ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করব। আল্লাহর কসম! আমার এ বিশ্বাস যে আল্লাহ আপনাকে আপনার সঙ্গীদ্বয়ের সঙ্গে রাখবেন। আমার মনে আছে, আমি অনেকবার নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি, আমি, আবু বকর ও ওমর গেলাম। আমি, আবু বকর ও ওমর প্রবেশ করলাম এবং আমি, আবু বকর ও ওমর বাহির হলাম ইত্যাদি। (সহিহ বোখারি : ৩৬৮৫)।
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.) এর অনুমতিক্রমে ওমর (রা.) কে তার সঙ্গীদ্বয়ের পাশেই দাফন করা হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের একজন ওমর (রা.) এর অনুসারী ন্যায়পরায়ণ পরহেজগার শাসক দান করুন।