মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) এর বংশধররা কুরাইশ বংশের অন্তর্গত। এ বংশ থেকেই মহানবী (সা.) এর আগমন ঘটেছে। আবার এ বংশের লোকজনই মহানবী (সা.) এর নবুয়ত বিষয়ে চরম বিরোধিতা করেছে। মক্কা মোকাররমার কুরাইশ বংশের দিকে দৃষ্টি দিলে জানা যায়, আদম (আ.) কে প্রথম পুরুষ হিসেবে গণ্য করে ইবরাহিম (আ.) কে তার বিংশতিতম অধস্তন পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়। গড়ে ৩০ বছর করে প্রতি বংশস্তরের পার্থক্য মেনে নিলে ইবরাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন আদম (আ.) এর ৬০০ বছর পর। তার পূর্বপুরুষ হিসেবে নুহ (আ.) এর নামও উল্লেখ রয়েছে। তাকে আদম (আ.) এর দশম অধস্তন পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৪২)।
ইবরাহিম (আ.) এর দুই পুত্রের মধ্যে ইসমাইল (আ.) এর বংশে জন্মগ্রহণ করেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার অন্য পুত্র ইসহাক (আ.) এর বংশধর হলেন বর্তমানের ইসরায়েলি ইহুদিরা। বিশ্বখ্যাত মুসলিম গ্রন্থকার সুহাইল এবং ইতিহাসবিদ ইবনে জাবির তাবারিও উপরোক্ত সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। তারা উভয়েই বলেছেন যে, আদনান বিন উদদ বিন হামিশা থেকেই ইবরাহিম (আ.) এর পার্থক্য ৪০ পুরুষের। নবী ইসমাঈল (আ.) জন্মের পর ইব্রাহিম (আ.) বিবি-সন্তান দু’জনকে মহান প্রভুর নির্দেশে কাবা শরিফের নিকটস্থ এক জায়গায় রেখে যান।
উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত সেখান কোনো মানুষ বসবাস করত না। যেহেতু জায়গাটা ছিল পানিশূন্য মরুভূমি। পরে ইসমাঈল (আ.) এর পবিত্র পায়ের আঘাতে খোদা তায়ালা অলৌকিকভাবে পানির বন্দোবস্ত করে দেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে সেখানটায় জনবসতি গড়ে ওঠে। মক্কা মোকাররমায় কুরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছিল। কুরাইশ বংশের ১৫টি গোষ্ঠীর মধ্যে ৯টি গোষ্ঠী মক্কা মোকাররমায় কাবা শরিফকেন্দ্রিক মূর্তিপূজা নিয়ে ব্যবসা করত। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৩৯-৪৫, ১৯৯৪ ইফাবা)।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে ধর্মীয় অবস্থার অবনতি এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং মানবতার অবনতি ও অধঃপতন সেই সীমায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে, তা কোনো সংস্কারক ও চরিত্র শিক্ষকের সাধ্যের বাইরে ছিল। সমস্যা কোনো এক আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধন, কোনো বিশেষ অভ্যাসের পরিবর্তন অথবা কোনো ইবাদত-বন্দেগির প্রচলন কিংবা কোনো সমাজে সামাজিক সংস্কারক ছিল না। না, এর জন্য সেই সংস্কারক ও এবং চরিত্র শিক্ষক যথেষ্ট ছিলেন, যা থেকে কোনো যুগ ও কোনো এলাকা, কখনও মুক্ত ছিল না। তবে সমস্যা ছিল এই যে, জাহিলিয়াতের ও মূর্তিপূজক এবং মানবতার এই ধ্বংসাত্মক আবর্জনাকে কীভাবে সরানো হবে এবং পরিষ্কার করা হবে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বংশানুক্রমে জমা হচ্ছিল। যার নিচে আম্বিয়ায়ে কেরামের বিশুদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কারের চেষ্টা-সাধনা ও সমাহিত ছিল।
এই সমস্যা ও ফেতনা-ফ্যাসাদের জড় চিরদিনের জন্য খতম করা এবং মূর্তিপূজার বুনিয়াদকে ধরে মূলে এমনভাবে উৎপাটন করা দরকার ছিল যে, দূর-দূরান্তের কোনো চিহ্ন ও নামণ্ডনিশানা যেন অবশিষ্ট থাকতে না পারে। তাওহিদি আকিদা-বিশ্বাস মানুষের মনের গহিনে কার্যরত এমনভাবে যেন বদ্ধমূল দৃঢ়মূল করে দেওয়া যায়, যার বেশি কল্পনা করাও কষ্টকর। সেই অন্ধকার যুগের আধার পরিসমাপ্তি গঠনের জন্য রব্বুল আলামিন জগৎবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) কে। (নবীয়ে রহমত পৃষ্ঠা ৭৯, ইফাবা)।
তবে এখন প্রশ্ন জাগে, বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) কে কুরাইশ বংশে কেন পাঠানো হলো?
এ প্রশ্নে প্রথম জবাবে বলা হবে-আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা ও হেকমতের ফায়সালা ছিল মানবজাতির হেদায়াত ও নাজাত তথা পথ প্রদর্শন ও মুক্তির লক্ষে এমন এক সূর্যকে পাঠানোর প্রয়োজন, যে সূর্য সমগ্র সৃষ্টিজগতে আলো বিস্তার করে অন্ধকার দূর করবে। সেই লক্ষ্যে রাব্বুল আলামিন সূর্যকে পাঠিয়েছেন এবং সেই সূর্যটাকে কুরাইশ বংশে পাঠানো রাব্বুল আলামিন উপযুক্ত মনে করেন। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, একেবারে স্বচ্ছ নির্মল পূর্ব থেকে কোনো অঙ্কিত ছবি কিংবা চিত্র কুরাইশদের কলবে ছিল না।
ভারতীয়রা যাদের নিজেদের উন্নতি অগ্রগতি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা এবং নিজেদের সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি ও দর্শনের ব্যাপারে বিরাট গর্ব বোধ করত, এর দরুন তাদের ভেতর এমন কিছু মানসিক ও চিন্তাগত জটিলতা সৃষ্টি হয়ে গেছে, যা দূর করা সহজসাধ্য কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু কুরাইশদের মন-মস্তিষ্ক সেরকম ভরপুর ছিল না। এই কুরাইশরা তাদের আপন প্রকৃতিতে ছিল সমুজ্জ্বল মজবুত ও শক্তিশালী। যদি হক কথা তাদের উপলব্ধিতে ধরা না দিত, তাহলে তারা এর বিরুদ্ধে তলোয়ার হাতে তুলে নিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করত না। আর যদি সত্য, সুন্দর দর্পণের মতো তাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ধরা পড়ত, তাহলে তা তারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করত। প্রাণের অধিক ভালোবাসা দিয়ে সেই সত্যটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরত। এর জন্য প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করত না।
যেহেতু তাদের মধ্যে এই বদ্ধমূলতা আগে থেকেই বিরাজমান ছিল। তাই রাব্বুল আলামিন বিশ্বনবীকে কুরাইশ বংশে প্রেরণ করেন। তবে এ কথার চেয়েও বড় সত্য হলো, ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া। (তারিখে তাবারি : ১/৩৬)।
সর্বজনীন বিশুদ্ধতম মত হলো রাসুলের আবির্ভাব ছিল নবী ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.) এর সেই দোয়ার ফল, যা তারা কাবাগৃহের উত্তোলন করতে গিয়ে এবং তা পুনরায় নির্মাণ করার সময় করেছিলেন। সে দোয়াটি এরকম, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসুল প্রেরণ করো। যে তোমার আয়াতগুলো তাদের কাছে আবৃত্তি করবে। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা বাকারা : ২২৯)।
আল্লাহ তায়ালার এক চিরন্তন নিয়ম হলো, তিনি তাঁর একনিষ্ঠ সত্যনিষ্ঠ ও আপন সত্তার সঙ্গে মিলনাকাক্সক্ষী ও ক্ষমা ভিক্ষার আঁচল বিস্তারকারীদের দোয়া অবধারিতভাবে কবুল করে থাকেন। আম্বিয়ায়ে কেরাম ও নবী-রাসুলদের মতবাদ তাদের চেয়েও আরও বহু ঊর্ধ্বে। তাহলে তাদের দোয়া আরও বহু আগেই কবুল করবেন। আসমানি সহিফা ও সত্য সংবাদগুলো এসব উদাহরণে ভরপুর। স্বয়ং তাওরাতে এর প্রমাণ বিদ্যমান আছে, আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া কবুল করেন।
তাতে এ কথা উল্লেখ করা আছে, ইসমাইল (আ.) এর অনুকূলে আমি তোমার কথা শুনলাম। দেখো আমি তাকে প্রাচুর্য দান করব। তাকে সৌভাগ্যশীল করব এবং তাকে খুব বর্ধিত করব। তার থেকে ১২ জন সরদার জন্ম নেবে। তাকে বিরাট বড় জাতি বানাব। এ জন্য রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি নিজের সম্পর্কে বলতেন আমি ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া এবং ঈসা (আ.) এর সুসংবাদের ফসল।
আর ইব্রাহিম (আ.) এর বংশধর হলো কোরাইশ গোষ্ঠী। তাহলে আমাদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল, রাসুলকে কেন কুরাইশ বংশে পাঠানো হয়েছিল? (নবীয়ে রহমত পৃষ্ঠা ৭৫-৭৬, ইফাবা)।