ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আমার চেতনায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

সৈয়দ আবুল হোসেন
আমার চেতনায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৭ মার্চ, ১৯২০। এর একত্রিশ বছর পর ১৯৫১ সালে আমার জন্ম। আমার জন্মের সময় বঙ্গবন্ধু তখনও ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেননি। জাতির জনক তিনি অনেক পরে। আমার জন্মের সময় তিনি পরিপূর্ণ একজন যুবক। একজন তুখোড় ছাত্রনেতা। একজন প্রতিবাদী মানুষ। যেখানে অন্যায়, অবিচার এবং শোষণ-বঞ্চনা-সেখানে তরুণ শেখ মুজিবের প্রতিবাদী উপস্থিতি দৃশ্যমান ছিল। ক্রমশ তিনি একজন জনদরদি রাজনীতিক, উদার ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন মানবদরদি নেতা হিসেবে, মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিচিতি পান। এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কাছে জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ান। আমি যখন শৈশবে তখন তিনি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের হর্সসিটে। এরই মধ্যে তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণ উচ্চকিত করেন। চুয়ান্নুর নির্বাচনে নিজের স্বকীয়তার পরিচয় দেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে তার নেতৃত্বের আলোকরশ্মি প্রজ্জ্বলিত হয়। ছিষট্টির ৬-দফা কর্মসূচিতে তার চিন্তাধারা ও নেতৃত্ব পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তার অবদান ও ভূমিকা তাকে ‘শেখ সাহেব’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’তে উন্নীত করে। সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে অভিসিক্ত করে।

ষাটের দশকের প্রথম দিকে শৈশবে একদিন আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধু ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মাদারীপুর এসেছিলেন। বিকালে জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। আমি বাবার সঙ্গে সে ভাষণ শোনার জন্য নৌকায় করে মাদারীপুর এসেছিলাম। বঙ্গবন্ধু ও সোহরাওয়ার্দীর ভাষণ শুনেছিলাম। সোহরাওয়ার্দীর ভাষণ বুঝতে পারিনি। তবে বঙ্গবন্ধুর কথা বুঝতে পেরেছি। সেদিন বঙ্গবন্ধু হাফ শার্ট ও প্যান্ট পরিহিত ছিলেন। আর সোহরাওয়ার্দী পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত ছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছি। তার নেতৃত্বের কথা নানাভাবে জেনেছি। আমি মফ স্বলের ছেলে। মাদারীপুরের ডাসার আমার গ্রাম। শৈশব ও স্কুল জীবন কেটেছে এ প্রত্যন্ত ডাসার গ্রামে। স্কুলের পড়াশোনা গৈলা স্কুলে। তারপর গৌরনদী কলেজে। সে সময় মাদারীপুর ছিল রাজনৈতিক সচেতন এলাকা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম চারণভূমি। শৈশবে, স্কুল জীবনে বাবা-মার কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক সাহসী গল্প শুনেছি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার প্রতিবাদী ভূমিকার কথা শিক্ষকদের কাছ থেকেও জেনেছি। তবে এ সময় এ সব কথা আমার ছোট মনে দাগ কাটেনি। কলেজ জীবনে ছাত্র-আন্দোলনের কারণে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে। ক্রমশ নিজেকে পড়াশোনার পাশাপাশি এসব আন্দোলনে সম্পৃক্ত করি। ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশে যোগ দিই। সত্তর দশকের প্রথমভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উত্তাল ছিল। সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার নির্দেশনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকল সমাবেশে যোগ দিতাম। এ সময় আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, তার চিন্তাধারায় নিজেকে নির্মাণের চেষ্টা করি।

১৯৭১ সাল। ২ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ এদিন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ক্যাম্পাসে উত্তোলন করে। এবং মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যায়। এ মিছিলে আমি সম্মুখভাগে ছিলাম। সেই দিনই আমি বঙ্গবন্ধুকে আবার পরিপূর্ণভাবে সামনে থেকে দেখি। নিজেকে গর্বিত মনে করি। সেদিনকার বঙ্গবন্ধুর সেই চেহারা আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে। তার চোখ দুটি ছিল মায়াভরা। সুন্দর ও ভালোবাসায় সিক্ত। দৈহিক গড়ন ও উচ্চতা মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দর্শনীয় সুপুরুষ। তার দরাজ গলা আমাকে অভিভূত করে। আমার মন খুশিতে উদ্বেলিত হয়। একজন বড় মাপের নেতাকে কাছে থেকে দেখার আনন্দই বিরল। পরবর্তী সময়ে ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণ ছিল আমাদের তরুনদের জন্য, জাতির জন্য একটি স্বাধীনতার দলিল। মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর সেই ডাক- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আজও হৃদয়কে প্রকম্পিত করে। এই ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আমি পড়াশোনা ও কর্মজীবনে জড়িয়ে যাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর সামনাসামনি দেখা হয়নি। আজ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পুনঃদেখা না হওয়ার দুঃখবোধ আমাকে ব্যথিত করে।

১৯৭৫ সাল। ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। অন্ধকারতম অধ্যায়। এদিনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। অথচ বঙ্গবন্ধু ছিলেন এদেশের মাটি ও মানুষের মহান নেতা। আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ। একজন মানবদরদি, দেশপ্রেমিক এবং একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার রূপকার। তিনি ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বিস্মৃত বাঙালি জাতিসত্ত্বার পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী মহান নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের স্থপতি এবং জাতির জনক।

১৯৭৫ সাল। ১৫ আগস্ট। এদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি- ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান- শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী কামালকে হত্যা করে। হত্যা করে বৃহত্তর পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যকে। কী নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ড থেকে শুধু বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা- জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এই দু’বোন সে সময় বিদেশে ছিলেন। আজও তারা বেঁচে আছেন শোক নিয়ে। বেঁচে আছেন, বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। দুঃখী ও দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। আল্লাহ মনে হয়, এদেশের মানুষের সেবার জন্য তাদের দু’বোনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। এ বছর সাতচল্লিশতম জাতীয় শোক দিবস। বঙ্গবন্ধুর সাতচল্লিশতম শাহাদতবার্ষিকী। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এদেশের আপামর মানুষ জাতীয় শোকদিবস হিসেবে দিনটি পালন করে। নতুন প্রেরণা ও নতুন অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হয়। এদিন আমরা শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হারায়নি- হারিয়েছি দেশের পরম আত্মীয়কে, মহান নেতাকে। জাতীয় উন্নয়নের এক মহানায়ককে। আমাদের একজন অত্যন্ত কাছের মানুষকে। এদিনে আরও হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে। মুক্তিকামী মানুষের আত্মাকে। মুক্তিকামী মানুষের চেতনাকে। বিতর্কিত করা হয় আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ও আমাদের জাতীয় পতাকাকে। আমাদের জাতিসত্তাকে। এদিন আমরা আরও হারিয়েছি, বাঙালি জাতির গর্ব ও অহংকার। সোনার বাংলা গড়ার মানুষটাকে। প্রিয় নেতাকে। একজন দুরদর্শী নেতাকে। একজন সাহসী নেতাকে। স্বাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করা মহান মানুষকে। আমাদের বাঙালি জাতির জন্য এটা একটা বেদনাদায়ক ঘটনা। শোকাবহ ঘটনা। অশ্রুভেজা দুঃখজনক ঘটনা। আজ যখন আমরা ১৫ আগস্টকে ফিরে দেখি, তখন মনে হয়, মানুষকে ভালোবাসা ও বিশ্বাস করার জন্যই বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে মুছে দিতে পারেনি। তিনি বাঙালির কাছে চিরস্মরণীয় একটি নাম। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যক্তিত্ব। তার আদর্শ, রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তাঁর জীবন ও কর্মের স্মৃতি আলোকিত শিখার মতো আমাদের অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এই প্রেরণাই আমাদেরকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবে।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৭ মার্চ, ১৯২০। তার মৃত্যু ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। তিনি ৫৫ বছর ৫ মাস ৮ দিন বেঁচে ছিলেন। এ অল্প সময়ে তিনি তার রাজনীতির মাধ্যমে, মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে ইতিহাসে কালজয়ী ব্যক্তিত্বে আসীন হয়েছিলেন। তিনি জাতির কাছে, পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করেছিলেন- একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। মানুষের ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায়। তিনি কাজের মাধ্যমে, বাঙালি জাতীয়বাদ উম্মেষের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশ্বের নির্যাতিত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজের অবস্থা বিনির্মাণ করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিশ্ববাসীর প্রাণের স্পন্দন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ভরসা। মুক্তি দিক-নির্দেশনা।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ব্রিটিশ-ভারতে। তিনি ব্রিটিশদের অত্যাচার, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখে বড় হয়েছেন। জ্ঞান হওয়ার পর স্কুলজীবন থেকে সমাজের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। তিনি কিশোর বয়স থেকেই মানুষের কথা ভাবতেন। মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। চল্লিশদশক থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি রাজীতিবিদ হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ’৫১ ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর নির্বাচন, ৫৮’র সামরিক শাসন, ৬২’র শিক্ষাআন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম- প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এই নেতৃত্ব ছিল- জাতির মুক্তির, স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা, ম্যাগনাকাটার। এর আগে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি শরিক হোন। দৃশ্যমান ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। দেশ বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও ঐতিহ্য নিয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চক্রান্তেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন- পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্রিটিশদের দলভুক্ত। যে উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সৃষ্টি তা সফল হতে দেবে না- পশ্চিমা শাককগোষ্ঠী। ব্রিটিশদের মতো এ আর একটি বেনিয়া দল। তাই বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধিকার অর্জনে এগুতে লাগলেন। স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল- এ অঞ্চলের মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি এ অঞ্চলের মানুষের জাতিগত পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসেন। আলাদা জাতিসত্তার ভিত রচনা করেন। তার ভাবনা ছিল, তার রাজনীতি ছিল- এই বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ। অধিকারবঞ্চিত মানুষ। বাঙালির স্বার্থ, বাঙালির উন্নয়নই ছিল তার রাজনীতির মূল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে- তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশ ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোনো ধরনের প্রলোভন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাকে মানুষের স্বার্থরক্ষা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন নির্ভীক, আপসহীন। আশৈশব সংগ্রামী ভূমিকায় জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে তিনি কখনও কোনো চাপের কাছে মাথানত করেননি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, দেশের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি গণতান্ত্রিক ন্যায়পরায়ন দেশ- যেখানে শোষন-বঞ্চনা থাকবে না। দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হবে। দেশের দুঃখী ও দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। মানুষ সুখে থাকবে। শান্তিতে থাকবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন- একজন নির্ভীক ও আত্মবিশ্বাসী নেতা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। ১৯৪৭ সাল থেকে রাজনীতি করেছেন এ অঞ্চলের, পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায়। বাঙালির বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এ কাজের পুরস্কার হিসেবে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী ১৯৪৮ সালের মার্চে তাকে কারাবন্দি করেন। এটা বঙ্গবন্ধুর প্রথম কারাবাস। শেষ কারাবাস মার্চ, ১৯৭১-এ। এর মধ্যে তিনি থেমে থেমে প্রায় ১৩ বছর জেল খেটেছেন। দু’বার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। প্রথমবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়- বন্দি অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। শেষবার মুক্তিযুদ্ধের সময় লাহোরে ইয়াহিয়ার প্রহসনমূলক মামলায় মৃত্যুদণ্ড। দু’বার চেষ্টা করেও শাসকগোষ্ঠী তাঁকে মারতে পারেনি। রাখে আল্লাহ মারে কে? কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তার নিজের দেশের কতিপয় কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। হত্যা করে একটি জাতির সুন্দর পথচলা ও ভবিষ্যৎকে।

সে সময় বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকরা ক্ষান্ত হয়নি। ঘাতকের পিছনের ক্রীড়নক খুনি মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইতিহাসকে আরও কলংকিত করে। এই অধ্যাদেশের দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সারের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছু ঘটুক না কেন- এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন- তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এরপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান সেই অধ্যাদেশকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন। এভাবে মোস্তাক, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষাকবচ ব্যূহ তৈয়ার করেন। এবং খুনি চক্রকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দেন। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সেই কালো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। নানা বাধা অতিক্রম করে খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং বিচার শেষে বেশ কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর করে।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বড় মাপের মানুষ। অনন্য সাধারণ একজন মানুষ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ। একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক। অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন। সহজে মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নাম মনে রাখার উদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। তার কথা ও ব্যক্তিত্ব ছিল শ্রদ্ধা করার মতো। তিনি যা বলতেন, চিন্তাভাবনা করে বলতেন। বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতেন। সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তাতে অটল থাকতেন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন না। বঙ্গবন্ধুর এ সাহসিকতাই তাকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছে, জাতির জনকের মর্যাদা দিয়েছে। তিনি রাজতিলকে অভিসিক্ত হয়েছেন।

প্রত্যেক জাতীয় শোক দিবসে আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি। চোখের পানি ফেলি। বেদনায় অশ্রুসিক্ত হই। শোকে কাতর হই। এই শোক আমাদের অন্যরকম একটা শক্তি দেয়, অন্যরকম প্রত্যয়ে আমাদের উজ্জীবিত করে। এই শক্তি, এই উজ্জীবিত হওয়া বোধের নামই- দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনে আমাদের সম্পৃক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রকৃত পথপ্রদর্শক। তাই বাঙালি জাতি, বাংলাদেশের মানুষ- বঙ্গবন্ধু’র কাছে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৪৫ বছর পার হয়েছে। এখন আর আমাদের ট্রায়ালের সময় নেই। আত্মপ্রতারণা করার সুযোগ নেই। করোনা মহামারিকে পুঁজি করে দুর্নীতিবাজ হওয়ার প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ নেই। আত্মপর্যালোচনার সময়। আত্মজিজ্ঞাসার সময়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও ন্যায়ের পথ অনুসরণের সময়। তাই সবাইকে, বিশেষ করে, নতুন প্রজন্মকে অনুরোধ করব- বঙ্গবন্ধুকে বেশি করে জানুন। তাকে বুঝার চেষ্টা করুন। ইতিহাস পড়ুন। মনে রাখবেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির পথ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন ও মানবিক চিন্তাবোধ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তবায়নই আমাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ।

আজ ভালো লাগছে এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের ‘হর্সসিটে’ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকার। একজন যোগ্য ও বড় মাপের রাজনীতিবিদ। তিনি পিতার মতো দেশের মানুষ নিয়ে ভাবেন। দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এরই মধ্যে জাতির পিতার হত্যা বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অসংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের সুযোগও বন্ধ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ আর্থসামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে করোনা মহামারি অর্থনৈতিক ভিতে ফাটল ধরিয়েছে। এতদ সত্ত্বেও জননেত্রী শেখ হাসিনা এই মহামারির রশি টেনে ধরেছেন। মৃত্যুর ঝুঁকিসহ এর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার এ পদক্ষেপ বিশ্বনেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করেছে। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে, বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ দেশের উন্নয়নে এখন প্রয়োজন- সবার অংশগ্রহণ। সবার পজিটিভ চিন্তা ও তার বাস্তবায়ন। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আমাদের উন্নয়নের ধারাকে কেউ বন্ধ করতে পারবে না। আসুন, আমরা দলমত নির্বিশেষে জাতির পিতার শোককে শক্তিতে পরিণত করে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রচেষ্টায় জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবরূপ পাবে। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী

শিক্ষা-উদ্যোক্তা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত