ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মিরাজের ভেল্কিতে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে বদলা নিল বাংলাদেশ

মিরাজের ভেল্কিতে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে বদলা নিল বাংলাদেশ

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নতুনের কেতন উড়ানোর অঙ্গীকার করেছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। স্বপ্নে বুক বেঁধেছিল লাল সবুজের সমর্থকরা। কিন্তু সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে পুরোনো দিনের গানই শুনিয়ে ছিলেন স্বাগতিক দলের খেলোয়াড়রা। মেহেদী হাসান মিরাজ ছাড়া প্রত্যাশা মতো পারফরম্যান্স করতে পারেনি কেউই। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই পিছিয়ে থেকে সেই টেস্টে হেরে বসে টাইগাররা। এই হারে নিজেদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই অবস্থান থেকে ফিরে আসার চ্যালেঞ্জ ছিল চট্টগ্রামে। আপাতত দৃষ্টিতে কঠিন হলেও চ্যালেঞ্জটি বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। জিম্বাবুয়েকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ জিতে সিলেটে হারের বদলা নিলো বাংলাদেশ।

গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লা. লে. মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের তৃতীয় দিনে এসে জিম্বাবুয়েকে ইনিংস ও ১০৬ রানে হারিয়েছে টাইগাররা। ফলে সিরিজে সমতা আনলো দলটি। প্রথম ইনিংসে ২১৭ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাটিংয়ে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১১১ রানে গুটিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশের তাদের প্রথম ইনিংসে করে ৪৪৪ রান। পেয়ে যায় ২১৭ রানের লিড। সেই ব্যবধান ঘোচাতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। প্রথম টেস্টে বিব্রতকর পরাজয়ের পর নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিতে দাপুটে জয় প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। ইনিংস ব্যবধানের জয়ে সেটি নিশ্চিত করে দেশের মাটিতে ছয় ম্যাচ পর জিতে মাঠ ছাড়ে শান্তর দল।

বাংলাদেশের এই জয়ের মূল নায়ক অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। তার সেঞ্চুরিতেই বড় লিড পায় টাইগাররা। এরপর তুলে নেন ফাইফার। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে একই টেস্টে কোনো ইনিংসে পাঁচ উইকেট ও সেঞ্চুরি পেলেন মিরাজ। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ১০৪ রান করেন তিনি। ১৬২ বলের ইনিংসে ৩৬ রান ছুঁয়ে টেস্টে ২ হাজার রান পূর্ণ করেন ২৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার।

সিলেট টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে ২০০ উইকেটের মাইলফলকও পূর্ণ করেছিলেন মিরাজ। এই সংস্করণে বাংলাদেশের হয়ে তার আগে ২ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের ‘ডাবল’ আছে শুধু সাকিব আল হাসানের। ম্যাচের হিসেবে সাকিবকেও ছাড়িয়ে গেছেন মিরাজ। ৫৪তম টেস্টে এই ডাবল পূর্ণ করেন সাকিব। মিরাজের এটি ৫৩তম ম্যাচ। কীর্তিময় দিনে বল হাতেও জাদু দেখান মিরাজ। জিম্বাবুয়ের ব্যাটিংয়ে ধস নামিয়ে ৫ উইকেট নেন অভিজ্ঞ অফ স্পিনার।

একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের তৃতীয় ক্রিকেটার মিরাজ। তার আগে এই কীর্তি গড়েন সাকিব আল হাসান (২ বার) ও সোহাগ গাজী। দিনের শুরুতেই অবশ্য ভাগ্যের সহায়তা পান মিরাজ। ভিনসেন্ট মাসেকেসার বলে তার ক্যাচ ছেড়ে দেন টাফাডজোয়া সিগা। ১৭ রানে বেঁচে গিয়ে আর ভুল করেননি মিরাজ। জিম্বাবুয়ের নির্বিষ বোলিংয়ে সুযোগ পেলেই বাউন্ডারি মারতে থাকেন। অন্য প্রান্তে তাইজুল রাখেন নির্ভরতার ছাপ। দুজন মিলে গড়ে তোলেন ৬৩ রানের জুটি। দিনের দশম ওভারে ভাঙে অষ্টম উইকেটের বন্ধন। মাসেকেসার ঝুলিয়ে দেওয়া বলে ড্রাইভ করার চেষ্টায় ক্রিজ থেকে বেরিয়ে যায় তাইজুলের পা। বেলস ফেলে তার বিদায়ঘণ্টা বাজান সিগা। ৪৫ বলে ২০ রান করেন তাইজুল।

তখনও ফিফটিই হয়নি মিরাজের। সেঞ্চুরির কথা হয়তো চিন্তাও করছিলেন না তিনি। তবে দশ নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করেন তানজিম। তার ব্যাটিংয়ে ভরসা পেয়ে মিরাজও এগোতে থাকেন তিন অঙ্কের দিকে। প্রথম সেশনে শুধু তাইজুলের উইকেট হারিয়ে ১১৩ রান করে বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে প্রায় ২ বছর ও ১৫ ইনিংস পর তারা করে ফেলে ৪০০ রান। মধ্যাহ্ন বিরতির পর ফিরে শর্ট বলের ফাঁদ পাতেন ব্লেসিং মুজারাবানি। তানজিমের হেলমেটে লাগে একটি বাউন্সার। হালকা লাফানো বলে চোখ সরিয়ে নেওয়ায় অন্য এক ডেলিভারি আঘাত করে মিরাজের কাঁধে। এরপর পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নেন মিরাজ। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে মুজারাবানির বুক উচ্চতার বাউন্সারে চমৎকার পুল শটে ছক্কা মারেন তিনি। একইসঙ্গে পৌঁছে যান নব্বইয়ে। তবে কিছুক্ষণ পর তিন অঙ্ক নিয়ে পড়ে যান শঙ্কায়। মাধেভেরের বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান তানজিম। তার গ্লাভস ছুঁয়ে যাওয়া বল সিলি মিড অফে সহজ ক্যাচ নেন নিক ওয়েলচ। ২ চার ও ১ ছক্কায় ৮০ বলে ৪১ রান করেন তানজিম। তার বিদায়ে ভাঙে ৯৫ রানের নবম উইকেট জুটি।

তখনও সেঞ্চুরি থেকে ২ রান দূরে মিরাজ। ওই ওভারের শেষ বলে ঠেকিয়ে দেন হাসান মাহমুদ। পরের ওভারের প্রথম বলে দুই রান নিতে গিয়ে প্রায় বিপদ ডেকে আনেন মিরাজ। তবে বাজে থ্রো করায় বেঁচে যান তিনি। ওভারের পাঁচ বল নিরাপদে কাটিয়ে দেন হাসান। পরের ওভারে কাঙ্ক্ষিত সিঙ্গেল নিয়ে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন মিরাজ। চার বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই মাঠেই নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। শতক ছুঁয়ে আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মাসেকেসার বলে ক্রিজ ছেড়ে খেলার চেষ্টায় স্টাম্পড হন মিরাজ। জিম্বাবুয়ের তৃতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকে পাঁচ উইকেট পান মাসেকেসা। ১১৫ রানে ৫ উইকেট নেন ২৮ বছর বয়সী লেগ স্পিনার।

২১৭ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে স্পিন দিয়ে বোলিং শুরু করে বাংলাদেশ। সপ্তম ওভারে দলকে প্রথম সাফল্য এনে দেন তাইজুল। দ্বিতীয় স্লিপে ব্রায়ান বেনেটের ক্যাচ নেন সাদমান ইসলাম। এক বল পর শট না খেলে ছেড়ে দেন নিক ওয়েলচ। বল প্যাডে লাগতেই জোরাল আবেদন হয়। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে আগের ইনিংসের ফিফটি করা ব্যাটসম্যানকে ফেরায় বাংলাদেশ। চা বিরতির পর নেমে প্রথম ইনিংসে দারুণ ব্যাটিং করা শন উইলিয়ামসকে বেশিক্ষণ টিকতে দেননি নাঈম হাসান। দ্বিতীয় স্লিপে সহজ ক্যাচ নেন সাদমান। ২২ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর প্রতিরোধের চেষ্টা করেন বেন কারান ও ক্রেইগ আরভাইন। দুজন মিলে গড়েন ৪৭ রানের জুটি। মিরাজের বলে প্রথম স্লিপে আরভাইনের ক্যাচ ছেড়ে তাদের কাজ সহজ করেন শান্ত।

১৬ রানে জীবন পেয়েও অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি আরভাইন। মিরাজের বলে ক্রিজ ছেড়ে খেলার চেষ্টায় বোল্ড হন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। একই ওভারের শেষ বলে পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ মাধেভেরে। মিরাজের পরের ওভারে সিলি মিড অফে ক্যাচ দেন টাফাডজোয়াকে সিগা। তখনও বাকি ৪ উইকেট। সপ্তম উইকেটে ২০ রান যোগ করেন কারান ও ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। পরপর দুই ওভারে দুজনকেই ফেরান মিরাজ। কারানকে কট বিহাইন্ড করে ক্যারিয়ারের ১৩তম পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন এই অফ স্পিনার। সেঞ্চুরি পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট-বিরল এক কীর্তিতে নাম লেখালেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর বাংলাদেশের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এক টেস্টে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন মিরাজ। সাকিবের এই কীর্তি আছে দুবার। সব মিলিয়ে টেস্টে ইতিহাসে এমন কীর্তি নেওয়ার ঘটনা ৩৯টি। এরপর স্লিপে দাঁড়িয়ে বোলারদের তাড়া দিতে থাকেন শান্ত, ‘আজকেই (বাসায়) যেতে চাই আমি। শেষ কর ভাই। শেষ কর।’

অধিনায়কের চাওয়া পূরণের কাজটি সহজ করে দেন রিচার্ড এনগারাভা। তাইজুলের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন তিনি। পরে সেই শেষ মুহূর্তের উত্তেজনা। দিনের নির্ধারিত ওভার শেষ হয়ে যাওয়ার পর সময় বাড়িয়েছিলেন আম্পায়াররা। বাড়তি সময়ের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই রানআউট হয়ে যান জিম্বাবুয়ের ভিনসেন্ট মাসেকেসা। মুমিনুল হকের থ্রো ভেঙে দেয় উইকেট। আর তাতে নিশ্চিত হয় চারদিনের মধ্যে বাংলাদেশের ইনিংস ব্যবধানে জয়। একইসঙ্গে পূর্ণ হয় জাকের, শান্তসহ পুরো দলের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত