আমরা বহু সৌভাগ্যবান জাতি। পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির এতসব রক্তাক্ষরে লেখা স্মরণীয় দিন আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের আছে স্বাধীনতা দিবস, যা ২৩ বছরের সংগ্রামের ফসল। বঙ্গবন্ধু প্রথমে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বাঙালিদের জন্য আর ২৬ মার্চ সারাবিশ্বের অবগতির জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেদিন পাকিস্তান আর্মি যদি আত্মসমর্পণ করত কিংবা সংগোপনে আমাদের মাটি ছেড়ে যেত, তাহলে আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হতে হতো না। আমরা যুদ্ধে জয়ী হলাম স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় ৯ মাস পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ্বের তথাকথিত দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী, মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর আমাদের বিজয় নিশ্চিত হলো। সে কারণে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। তবে কেমন করে বিজয় এলো, তা আমাদের প্রজন্ম জানলেও বর্তমান প্রজন্মের জন্য এই নিবন্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান আমাদের ওপর ক্র্যাকডাউন করল অর্থাৎ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এক অর্থে আমরা এই দিবসটির অপেক্ষায় ছিলাম, যাতে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি-নীতি লঙ্ঘন না করেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের অপারেশন সার্চলাইট, অর্থাৎ ক্র্যাকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়া ছাড়া আমাদের উপায়ন্তর ছিল না। এমন যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হতে যাচ্ছে, সে কথা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট জানতেন। তবে আমরা তার মুখ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৭১) এ কথা জানলাম। সেদিন আমি ও শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর অফিসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের আলোচনার সারমর্ম জানতে গিয়েছিলাম। সেখানে জানলাম যে, ফারল্যান্ড প্রথমে আমাদের নিঃশর্ত সমর্থনের কথা বললেও পরবর্তী সময়ে তার সুর বদলে যায়। শর্ত সাপেক্ষে সাহায্যদানের কথায় বঙ্গবন্ধু রেগে যান এবং আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন অসম্ভব বলে জানালেন। বঙ্গবন্ধু ফারল্যান্ড এবং ইয়াহিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন ঘড়ঃযরহম ংযধষষ মড় ঁহপযধষষবহমবফ। পরের দিন ইয়াহিয়ার ভাষণ বা বিবৃতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে তিনি জঙ্গি মিছিলের নির্দেশ দিলেন ও সশস্ত্র প্রস্তুতির শেষ নির্দেশ দিলেন। পাকিস্তান যখন আলোচনার ছদ্মাবরণে সশস্ত্র আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আমরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেই ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখেই সারাদেশের মানুষ তা ভিন্ন ভিন্নভাবে বুঝলেন ও আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা বুঝলাম সহজভাবে। ছাত্ররা যখন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা প্রদর্শন করল; আমরা শিক্ষকরা ৩ মার্চ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ৬ দফার বদলে এক দফার প্রস্তাব পাস করিয়ে নিলাম। আমি স্বকণ্ঠে তারস্বরে সে প্রস্তাব পড়ে শোনালাম। যার ফলে হয়তো বিকালে ছাত্ররা স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিল। সেদিন পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পতাকা উত্তোলন করল, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করল, সভার শুরুতে ও শেষে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, সংগীত গাওয়া হলো, গান স্যালুট দেওয়া হলো, তখন আসল বার্তা সারাদেশে পৌঁছে গেল। তারপর শুধু প্রতীক্ষার পালা, কখন তারা আঘাত হানে, তাহলে প্রতিঘাত হানাটা আর অপরাধ হবে না। এরই নামে আলোচনার নামে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলাটা চলল ২৩ মার্চ পর্যন্ত; যেদিন পাকিস্তানের প্রজাততন্ত্র দিবসেও পাকিস্তানি পতাকা কোথাও উত্তোলিত হলো না, উত্তোলিত হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা। পরবর্তী ক’দিন উভয়পক্ষ জয়-জয় ভাব নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হলো। কোনো রকমে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার প্রত্যাশায় ইয়াহিয়ার দল ৬ দফার অন্তত চারটি দফা মেনে নিল। বঙ্গবন্ধুর দল কূটকৌশল হোক কিংবা নির্মম রক্তপাত এড়াতে তাতে নিমরাজি হলো। এর পরই ৪ দফার সঙ্গে আরও দুটি দফার কথা জানালেন বঙ্গবন্ধু। এই দুটি দফার একটি ছিল স্বতন্ত্র অর্থ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দুই প্রদেশে দুই জাতীয় মুদ্রা ও দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর অন্যটি ছিল এক লাখ আধা সামরিক বাহিনী গঠনের বিধান। ইয়াহিয়া এই প্রস্তাবের মমার্থ বুঝেই গুলি মেরেই সমস্যা সমাধান করার পথ নিল। বঙ্গবন্ধুও দেখলেন ৪ দফা গৃহীত হলে এক ধরনের কনফেডারেশন হবে, তবে স্বাধীনতা বিলম্বিত হয়ে যাবে, কিংবা অবস্থার চাপে পড়ে তা কোনো দিন অর্জিত নাও হতে পারে। তাই তুরুপের দুটি কার্ড তিনি শেষেই খেললেন। পরিণতি জেনেই তিনি স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের মাধ্যমে বলদা গার্ডেন থেকে প্রচার করালেন। ক্র্যাকডাউনের বেশ পরে নায়েক সুবেদার শওকত আলীর মাধ্যমে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি পাঠালেন। এই দুটি ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে ভর করে দেশময় ও বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিরোধ যুদ্ধ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র।
প্রতিরোধ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, যা ১৯৬১ সালে গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের রূপান্তরিত নাম। লিবারেশন ফোর্স থেকে মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যবধান খুব বেশি দিন ছিল না। অন্যরা প্রতিরোধ যুদ্ধ জুন মাস পর্যন্ত চালিয়ে জুলাই-আগস্ট মাস শেষে একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়লেও বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভারতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জোগান নিল। দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ শুরু করল। তারপর আমাদের নিয়মিত যোদ্ধা ও অন্য গণযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। ভারত থেকে আক্রমণ ঠেকাতে পাকিস্তান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হলো। ইত্যবসরে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সমঝোতার অংশ হিসেবে শেষোক্ত বাহিনী সীমান্ত এলাকা থেকে ২০ মাইল গভীরে তৎপরতার দায়িত্ব নিল। এ জন্য তাদের অতি উচ্চশিক্ষিত গেরিলা দল অতি উন্নতমানের হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। দেরাদুন ও হাফলংয়ে প্রশিক্ষণে প্রায় ১০ হাজার গেরিলা অংশ নিল। দেশে ঢুকেই প্রত্যেক যোদ্ধা আরও ১০ জন গেরিলা যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে পাকিস্তানিদের একাংশের ঘুম ও বিশ্রাম হারাম করে দিল। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর নিজস্ব গেরিলা যোদ্ধা ছিল। তারাও দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ সম্প্রসারিত করল। সশস্ত্র বাহিনী মোট ১০টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে ভারতীয় সেনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় যুদ্ধের গতি ফিরিয়ে আনল। এক পর্যায়ে যৌথ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হলো। আমরা অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌথ বাহিনীভুক্ত হলাম। নভেম্বর মাসের দিকে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ যোদ্ধাদের নিয়ে চাটগাঁ অভিমুখে যাত্রা করলে শেখ ফজলুল হক মনি আমাকে পূর্বাঞ্চল মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব দিলেন। শেখ মনি ও জেনারেল ওবান ভারতীয় বা অন্য কোনো বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই চাটগাঁ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। ৩ ডিসেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর প্রচ- আক্রমণে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই পাকিস্তানের কব্জামুক্ত হতে লাগল। পরাজয় নিশ্চিত জেনে সমূহ ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাকিস্তানি যুদ্ধবাজরা আত্মসমর্পণে রাজি হলো। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে আমাদের বিজয় নিশ্চিত হলো।