ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাঙালির চেতনা বিকাশের অনন্য স্মারক

বাঙালির চেতনা বিকাশের অনন্য স্মারক

বলা হয়ে থাকে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সংখ্যক সৈন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়; তারও বেশি অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য সংখ্যারও অধিক সাধারণ মানুষ দূরবর্তী অবস্থান থেকে সেই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে। সাধারণ মানুষ বুঝতেও পারেনি পরবর্তী প্রায় ২০০ বছরে তাদের জীবনে কী ঘটতে চলেছে। যদি তারা বুঝতে পারত তবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব জিনিস তারা ব্যবহার করত যেমন দা, কোদাল, লাঙলের ফলা, খুন্তি, কাচি, বল্লম, বাঁশের লাঠি, এসব দ্বারা ইংরেজ সৈন্যদের তাড়া করলে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হতো। ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতেও বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেনÑ ‘সেদিন স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজ সৈন্যদের প্রতিরোধ করতে চাইলেই লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল মেরেই তাদের খতম করে দিতে পারত। কিন্তু এ দেশবাসী তা উপলব্ধি করতে পারেনি। তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার তখন খুবই অভাব ছিল।’ সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে মীর জাফরদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতো। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই চেতনাবোধ ছিল না বলে ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেন।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ প্রায় ২০০ বছর ইংরেজরা এদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন ও শোষণ করে। এ সময়ে সাধারণ মানুষের মাঝে দেশপ্রেমের চেতনাবোধ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে, যখন ইংরেজদের অত্যাচারের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে এবং বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নানা বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার ইতিহাস আমরা জানতে পারি। এসব বিদ্রোহের অধিকাংশই সংঘটিত হয় বাঙালিদের দ্বারা। অসন্তোষ ও বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় বাঙালিদের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তার চেতনা বিকাশ লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি দেশ সৃষ্টি করে দিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এদেশ ভাগও বাঙালিদের শান্তি ও স্বস্তি দেয়নি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার হীন প্রয়াস থেকে।

ফলে বাঙালিরা আবারও বিদ্রোহ করে। তাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থে রাজপথে ঢেলে দেয় বুকের তাজা রক্ত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের চেতনা বিকাশের অন্যতম অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অধিকার বা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হয়। বাঙালিরা রক্তের বিনিময়ে অধিকার আদায়ের শিক্ষা অর্জন করে। এমনকি তারা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে।

ভাষা আন্দোলনে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও ছাত্র সম্প্রদায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তারা সাধারণ জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই ও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। অবশেষে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনে বাঙালিদের বিজয় হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিজয়ী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করে। একদিকে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য; অন্যদিকে, রাজনৈতিক দমন, পীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা বাঙালিদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সুতরাং তারা নিজেদের স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় আবারও সক্রিয় হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই চেতনা উন্মেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী নেতৃত্বের পাশাপাশি দেশের শিক্ষক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আরও উল্লেখ্য যে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই এই আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ও নেতৃত্ব প্রদান করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ক্রমাগত বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের লাহোরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চেয়ে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন।

৬ দফা ছিল বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’। ৬ দফার পক্ষে প্রচার চালাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। পাকিস্তান সরকার জানত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক দমন-পীড়নের জবাব হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের দলিল। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার জনপ্রিয়তায় আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে তাকে গ্রেপ্তার করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও সাধারণ ছাত্ররা ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ১১ দফা কর্মসূচি দিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। কারণ, ততদিনে বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার জনসাধারণের এক অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। কারণ তিনি তাদের মধ্যে চেতনা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চেতনার ইতিহাস রচনার বীজ বপন হয় সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। যেখানে বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছিল, রক্তের বিনিময়ে হলেও তারা তাদের দাবি আদায় থেকে পিছপা হবে না। বাঙালি জাতি তাদের আন্দোলন সংগ্রামের মূলমন্ত্র খুঁজে পায় ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফার ভিত্তিতে। আবার ছাত্ররাও সুনির্দিষ্ট ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে। আইয়ুব খান সরকার আগরতলা মামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টা চালালে তা বাঙালিদেরকে বারুদের মতো বিস্ফোরিত করে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে চরমভাবে উত্তেজিত করে। বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার যেকোনো মূল্যেই হোক দমন করতে চাচ্ছে এবং তা বাস্তবায়িত হলে বাঙালিদেরকে আরও কিছুদিন শাসনের নামে শোষণ করা যাবে। ফলে বঙ্গবন্ধুসহ সব আসামির মুক্তির দাবিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটায় এবং বঙ্গবন্ধুসহ সব আসামি মুক্তি পায়। এভাবে বাঙালির অনুপ্রেরণা এবং সাহস দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে তারা নতুন দিনের সোনালি সূর্যের আশায় দিন গুনতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির জাতীয় চেতনাবোধ এতই বৃদ্ধি পায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে তারা নির্বাচনে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এর বিশাল বিজয় এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভরাডুবিতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়। এজন্য ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। সংলাপের নামে কালক্ষেপণ করে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালালে অদম্য বাঙালি জাতি গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে শুরু হয় বাঙালির এক দফার আন্দোলনÑ স্বাধীনতার আন্দোলন। এর আগে ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক এক ভাষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা প্রদান করেন, যা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেন।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূরীকরণে তথা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, নির্যাতন-নিপীড়নের থেকে মুক্তির মহামাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক, দাবি আদায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়। লাখো শহীদের রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেখা দেয় সেই বহু আকাক্সিক্ষত মহামুক্তি। অর্জিত হয় বিজয়। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ। বিজয় দিবস বাঙালির চেতনা বিকাশের অনন্য স্মারক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত