নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ বিজয়ের ৫০ বছরে। যদিও আমরা নতুন প্রজন্ম স্বচক্ষে ১৯৭১ সালের বিজয় দেখিনি; দেখিনি সেই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। তবে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে। সেদিক থেকে নিজেই নিজেকে সৌভাগ্যবানদের কাতারে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধ না দেখলেও হৃদয় থেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছি অনুভবটুকু। কখনও কখনও তা দাদা-দাদি, বাবা-মা, চাচা-চাচির চোখে, প্রতিবেশী বয়োজ্যেষ্ঠদের চাক্ষুস বর্ণনায়, আবার কখনও কখনও বইয়ের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ছাপার অক্ষরে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখি, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, বুদ্ধিজীবীসহ আরও অসংখ্য শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বিজয়ের স্বাদ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তীতে এবারের বিজয়ের মাস বাঙালির কাছে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে এসেছে। ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনেক হারাতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। লাখো শহীদের রক্ত কি বৃথা গেছে? নাকি যে আকাক্সক্ষা নিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল লাখো মানুষ, তাদের সব আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে? স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি-না এমন প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার বিষয়ে নানা মহলের প্রশ্ন থাকলেও ৫০ বছরে দেশের অর্জন কিন্তু কম নয়। একসময়ের আমেরিকার কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আজ ‘উপচে পড়া ঝুড়িতে’ রূপ নিয়েছে। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ আজ রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।
আমি যেহেতু একজন কৃষিবিদ, কৃষির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করিÑ তাই বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে কৃষি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেব। বেশকিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭০ থেকে ’৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। তখন সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য এই পরিমাণ খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। যদিও এ সময়ের ব্যবধানে আজ দেশের মানুষ বেড়ে আড়াই গুণ হয়েছে। আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিন গুণেরও বেশি। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর ধরে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ এখন বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবে, দেশে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। চীন ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম, আর ভারত ১১ কোটি ৬৪ লাখ টন উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য মতে, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ এখন উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশেই। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কূটনীতিতেও ব্যবহার হচ্ছে মাছের রাজা ইলিশ। ২০০৮ থেকে ২০০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৯ থেকে ২০২০ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন বা ১ দশমিক ৮৩ গুণ। সেসঙ্গে আকারেও বড় হয়েছে ইলিশ। একসময় বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া দুরূহ ছিল, সেখানে বর্তমানে দুই কেজি কিংবা তার চেয়েও বড় আকারের ইলিশ বাজারে সচরাচর পাওয়া যাচ্ছে।
সোনালি আঁশ পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। মোট পাট উৎপাদিত হয় ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টন, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ। ২০ লাখ টন উৎপাদন করে ভারত বিশ্বে প্রথম। বিশ্বের ৫৫ শতাংশ পাট ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে। ৪৫ হাজার টন উৎপাদন করে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। বাংলাদেশ পাট থেকে প্রায় ২৮৫ রকমের পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর রপ্তানি করছে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি রপ্তানি বাড়ছে প্রতিবছর। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, যার সঙ্গে জড়িত ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। প্রতি হেক্টর জমিতে এখন গড়ে সাড়ে ২৩ টন আলুর ফলন হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় এখন অনেক বেশি আলু দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকায় বাংলাদেশের আলু রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। বছরে উৎপাদন হয় ২৪ লাখ টন। ১০ বছর আগে ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন নিয়ে অবস্থান ছিল দশম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানেও উঠেছিল। আম উৎপাদনে সবার ওপরে ভারত। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন। এছাড়া বিশ্বে বছরে ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। এ ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ১০ লাখ টন। বিশ্বে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টন কাঁঠাল হয় ভারতে। তৃতীয় এবং চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। ১০ লাখ ৪৭ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন করে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম স্থানে। ১ কোটি ৭৬ লাখ টন নিয়ে ভারত প্রথম এবং ৪৪ লাখ টন উৎপাদন করে চীন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশেই গবাদিপশুর লালনপালন বাড়তে থাকে। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে। এফএওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দুই দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন।
ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি। ধান বাদে অন্য সব ধরনের ফসল নিয়ে গবেষণা করা এই সংস্থা বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ৪৪টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে। এ জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনেরও বেশি এবং চিনি আহরণের হার ১২ শতাংশের ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে।
বর্তমান যুগকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির যুগ। বিশ্বে প্রতিদিন নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। আমাদের কৃষক এসব টেকনোলজি সহজে গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের কৃষি মেকানাইজেশনে এগুচ্ছে কিন্তু মেকানাইজেশনের পাশাপাশি ডিজিটাইলেজেশনেও এগুতে হবে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সেবা গ্রহণ, স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করে স্মার্ট ফার্মিং বা স্মার্ট এগ্রিকালচার বা প্রিসিশন এগ্রিকালচার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীতে নতুন নতুন যেসব যন্ত্রপাতি আসছে, সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিঙ্কস। যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধি ও রোবোটিকস, জৈব প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সয়েললেস এগ্রিকালচার, ডিপওয়াটার ইরিগেশন, হাইড্রোপনিক, এরোপনিক, কৃষিতে ড্রোন ব্যবহার, ন্যানো প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরোনো আমলের চাষাবাদ প্রণালি পরিবর্তন করে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদে মনোযোগী হতে হবে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে কৃষকদের কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা তাদের এ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। পাশাপাশি দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দামও নিশ্চিত করতে হবে।
সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ জরুরি। পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতকরণে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। সরকারের সঠিক নীতি সহায়তা, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তাভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্তি অনেকাংশেই সহজতর হয়েছে। এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১-এর আলোকে জাতীয় কৃষিনীতি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, ডেল্টাপ্লান : ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপ পাবে।
মোট কথা, করোনা সংক্রমণের কারণে দেশের সবকিছু যখন স্থবির, তখনও সচল ছিল কৃষির চাকা। দুঃসময়ে কৃষিই সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। শুধু করোনা সংকটে নয়, গত ৫০ বছরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে কৃষি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় উন্নতি।