ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/৮)

চিন্তার জাগরণেই তোমার পরিচয়

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
চিন্তার জাগরণেই তোমার পরিচয়

হালাব- আজকের আলেপ্পো। সিরিয়ার একটি জনপদ। হালাবের অধিবাসীরা ছিল শিয়া মতাবলম্বী। একবার আশুরার দিনে নারী-পুরুষের বিরাট জটলা হয়েছিল হালাব নগরীর এন্তাকিয়াগামী প্রবেশ দ্বারে। জনতা কান্নাকাটি-আহাজারি করছিল। বুক চাপড়ে শোকের মাতম তুলেছিল আকাশ-বাতাস ভারী করে। তাদের এই কান্না ছিল নবী পরিবারের ওপর জুলুম ও নিষ্ঠুরতার স্মরণে।

নালে ও নোহা কুনান্দ আন্দর বুকা

শিয়া আশুরা বরায়ে কারবালা

কান্না বিলাপ আহাজারির মাতম শোক

শিয়ারা কারবালা স্মরণে ভাসায় বুক। ৭৭৯

কাববালা প্রান্তরে নবীজি (সা.)-এর পরিবারের সদস্যদের ওপর জুলুমের স্মৃতিচারণ করছিল জনতা। এয়াজিদ শিমরের নিষ্ঠুরতার করুণ বর্ণনা দিচ্ছিল একেক করে। তখন হায় হোসাইন, হায় হোসাইনের মাতমরোলে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায়। গোটা জনপদ আশপাশের প্রান্তরভূমি যেন শোকার্ত জনতার কান্নায় একাকার। সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক ভিনদেশি কবি। কান্নার ধনি শুনে কবি থমকে দাঁড়ান। যাচ্ছিলেন শহরে। এখন গতি বদলে যাবেন জনতার কাতারে। যেই ভাবনা সেই কাজ। এন্তাকিয়া গেটের দিকে চললেন। জনতার এমন গণক্রন্দনের রহস্য তাকে উদ্ঘাটন করতে হবে।

কবি জিজ্ঞাসা করলেন, এ কেমন কান্না। কার জন্য নারী-পুরুষ, কিশোর, বৃদ্ধের এমন আহাজারি মাতম। নিশ্চয়ই শহরের রইস মারা গেছেন। নিশ্চয়ই বড় জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় ছিল তার সিংহাসন। তাই একত্রে জড়ো হয়ে জনগণের এমন মাতম ক্রন্দন। আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে তাকে হারিয়ে। গোটা জনপদ শোকে মূহ্যমান। এই রইসের বাড়ি কোথায়। তার এমন কি গুণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যার জন্য প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমি তো কবি, সেই মহতি রইসের জন্য আমার কাব্য প্রতিভা উজাড় করতে চাই। শোক গাঁথা মরসিয়া গেঁথে আমিও তোমাদের দলে শামিল হতে চাই।

অন য়্যকি গোফতাশ কে হাই দিওয়ানেই

তো নয়ি শিয়া আদুভভে খানেয়ি

বলে তাকে এক লোক তুমি উন্মাদ

শিয়া নও তুমি নবী বংশের দুশমন। ৭৮৯

তুমি শিয়া নও। নবী পরিবারের ভালোবাসা তোমার অন্তরে নেই। কিসের কবির ভাব দেখাও। এখান থেকে ভাগো। জান না-

রুজে আশুরা নমি দানি কে হাস্ত

মাতমে জানি কে আজ করনি বেহ আস্ত

আশুরার দিন জান না কার স্মরণ আজ

প্রিয়তম তিনি ছিলেন শতাব্দীর চেয়ে উত্তম। ৭৯০

একটি শতাব্দীতে কত লোক থাকতে পারে, চিন্তা কর। আজ যার শাহাদতবার্ষিকী, তার মর্যাদা এক শতাব্দীর সকল মানুষের চেয়ে উত্তম। তার জন্য শোক প্রকাশ, মাতম করা কি কোনো মুমিনের কাছে তুচ্ছ বলে গণ্য হতে পারে? যিনি শহিদ হলেন তিনি স্বয়ং নবীজির দোহিত্র। প্রিয়নবীকে ভালোবাসি, আর নবীজির প্রাণপ্রিয় নাতিকে ভালোবাসি না- তা কি হতে পারে। এ কারণে প্রতিটি মুমিনের কাছে কারবালার স্মরণে আশুরার শোকানুষ্ঠানের বিষয়টি বহুল পরিচিত ও প্রসিদ্ধ, যেমনটি নুহ (আ.)-এর সময়ের তুফান প্রসিদ্ধ। তুমি যে এসব না-জানার ভান করছ, তোমাকে কবি নয়, উন্মাদ বলাই উচিত।

কবি বলে, তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু যে ঘটনার কথা বলছ, তা তো এ যুগের নয়। এয়াজিদের যুগের বিয়োগান্ত ঘটনা। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার খবর তোমাদের কাছে পৌঁছতে এত দেরি কেন হলো, হিসাব মিলাতে পারছি না। আমার চিন্তা তোমাদের নিয়ে। এ ঘটনা চাক্ষুষ দেখার মতো। অন্ধ লোকেরাও যেন তা দেখেছে। বধিরের কানেও তা পৌঁছে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য লাগে সে খবর তোমরা এতদিন পাওনি। তোমরা এতকাল বেঘোরে ঘুমিয়েছিলে। আজকে জেগে উঠে মাতম শুরু করলে। কাজেই শোক ও মাতম শহিদদের জন্য নয়; বরং তোমাদের নিজেদের জন্যই কাঁদা উচিত।

পাস আজা বর খোদ কুনিদ আই খুফতেগান

যাকে বদ মরগিস্ত ইন খাবে গেরান

কাজেই নিজের জন্য কাঁদো ঘুমিয়ে কাটাও যারা

কেননা এই ঘুমঘোর মৃত্যুর চেয়ে কঠিন মৃত্যুফাঁড়া। ৭৯৫

তোমরা যেভাবে ঘুমিয়ে আছ, দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতায় মত্ত হয়ে আছ, নিজের আত্মার চাহিদা ভুলে দেহ ও জৈবিকতার খোরাক যোগান দিতে রাতদিন হুঁশজ্ঞান হারাচ্ছ, তা তো তোমার মরণের চেয়েও কঠিন। অন্যের মৃত্যু নিয়ে হাহুতাশ করার কী যুক্তি আছে, বল।

তিনি শহিদ হয়েছেন। কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে দ্বীনের তরে জীবন উৎসর্গ করেছেন। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ‘সর দাদ ন দাদ দস্ত দর দস্তে এজিদ’। এটি খাজা মুইন উদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর উক্তি। তার মানে, তিনি মৃত্যুকে বরণ করেছেন, তবুও মাথা নোয়াননি।’ এয়াজিদের হাতে হাত দেননি। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। নিজের মাথা নজরানা দিয়েছেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। শাহাদত মানে তার প্রাণ ডানা মেলে উড়াল দিয়েছে দেহের কারাগার ছেড়ে। তার জন্য তোমাদের এত কান্না কেন?

তিনি তো ছিলেন দ্বীনের বাদশাহ। দুনিয়ার কারাগারে বন্দি ছিলেন। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে উড়াল দিয়েছেন রুহের জগতে। তাই তার জন্য কান্নার পরিবর্তে আনন্দ করাই উচিত। যদি কাঁদতে হয় নিজের জন্যই কাঁদা উচিত। তোমার যদি দিব্যচক্ষু থাকে ইমামের এই পরিণতির জন্য তোমার আনন্দিত হওয়াই উচিত। কিন্তু জীবন মৃত্যুর রহস্য বুঝার শক্তি তোমার নেই। এ কারণে নিজের অবস্থার ওপর তোমার ক্রন্দন করা চাই। আর যদি বল যে, আমার দিব্যচক্ষু আছে। আমি মোমিন অদৃশ্যে বিশ্বাসী, তা হলে এই বিশ্বাসের প্রমাণ কী?

ওয়ার হামি বিনদ চেরা নবওয়াদ দলির

পোশত দার ও জান সেপার ও চশমে সির

অন্তর্চক্ষু যদি দেখে অন্যকিছু কেন সে সাহসী নয়

কেন ত্যাগ, তাওয়াক্কুল, লোভমুক্তিতে সজ্জিত নয়। ৮০৩

অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাসী বলে তোমার দাবি সত্য হলে, কেন তোমার মধ্যে তার প্রস্তুতি নেই। জীবন সংগ্রামে নানা সমস্যা মোকাবিলায় কেন আল্লাহর ওপর ভরসা করো না। সত্য ও ন্যায়ের ওপর তোমার অবিচলতা নেই কেন? তোমার মধ্যে কেন অল্পেতুষ্টির গুণ নেই, কেন তুমি মনের দিক থেকে ধনী নও? কেন পরমুখাপেক্ষী হয়ে চলতে অভ্যস্ত?

আমার প্রশ্ন, তোমার চেহারায় ঈমানের, ইবাদতের চিহ্ন কোথায়? তুমি দাবি কর, আমি আল্লাহর রহমতে বিশ্বাসী, আল্লাহর রহমতের পরশ ছাড়া কিছুতে কিছু হয় না- এ কথা মানি। আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা করেই আমার জীবন চলে। তার মানে রহমতের সাগরের সঙ্গে তোমার সংযোগ আছে। তা হলে বল, তোমার হাত কেন এখনও দানে দাক্ষিণ্যে প্রসারিত নয়। কৃপণতা কেন তোমাকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না? যার সঙ্গে সাগরের সংযোগ আছে, সে কি পানি বিলাতে কার্পণ্য করে। শুনোনি হাদিসে আছে, যে অন্যের প্রতি দয়া করে না, সে আল্লাহর দয়া পায় না। রহমতের মাস রমজান এলে নবীজির দয়া দাক্ষিণ্যের হাত প্রসারিত হতো। রমজানের শেষ দশকে গিয়ে তার দয়া দাক্ষিণ্যের অবস্থা হতো প্রবহমান বাতাসের মতো। এর কারণ, আল্লাহর রহমতের সাগরের সঙ্গে নবীজির সংযোগ ছিল এবং রমজানে তাতে জোয়ার বয়ে যেত।

তুমিও আল্লাহর রহমত পাও ঠিক; কিন্তু সেই রহমত তুমি গ্রহণ কর পিঁপড়ার মতো। ধানগমের স্তূপে এসে একটি দানা পেয়েই পিঁপড়া দৌড় দেয়। লোভাতুর অন্ধের মতো শস্যদানাটি মাথায় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকানোর ফুরসত থাকে না তার। অথচ দৃষ্টিকে প্রসারিত করলে সে দেখত এখানে তো একটি বা দুটি দানা নয়; অগণিত অসংখ্য দানা পড়ে আছে স্তূপে। আর তার পাশে আছেন ধনভাণ্ডারের মালিক।

মালিক ডাক দিয়ে বলেন, হে পিঁপড়া, একটি দুটি দানা পেয়ে খোঁড়তে খোঁড়াতে দৌড় দিও না। দেখ তোমার সামনে অফুরান ধনভাণ্ডার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মানব দানবের বাদশাহ মহামতি সুলায়মান। তার কাছে আছে দয়া দান অফুরান। তোমার দৃষ্টিশক্তির সংকীর্ণতাই তোমাকে কোণঠাসা করে রেখেছে। তুমি যদি তোমার দৃষ্টিশক্তিকে অনেক বড় প্রসারিত করতে পার, তাহলে লোভ মোহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে, বস্তু ও দুনিয়ার বিষয় সম্পদ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছেড়ে সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণে রাখতে পারবে, তখন দ্বীনের পথে অবিচল থাকা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। দুঃখ-কষ্টের ভেতরও জীবনের স্বাদ তুমি লাভ করতে পারবে। জীবন জগতের রহস্যগুলো তোমার সামনে উদ্ভাসিত হবে। কেননা, মানুষের আসল পরিচয় তার চিন্তা, চেতনা, নিয়ত ও সংকল্পের মধ্যেই নিহিত। মওলানা রুমি কথাটি এভাবে বলেন-

আদমি দিদ আস্ত বাকি গুশত ও পুস্ত

হারচে চশমশ দিদে আস্ত আন চিজ উস্ত

মানুষ হলো তার দৃষ্টিভঙ্গি বাকি সব গোশত ও চর্ম

যা কিছু তার চিন্তায় ভাসে সেটিই তার পরিচয়। ৮১২

মানুষের চিন্তাধারাই তার আসল পরিচয়। কারও চিন্তা যদি হয় ফুলের মতো সুন্দর, আকাশের মতো উন্নত প্রসারিত, তাহলে তার পরিচয়, সে ফুলবন, তার ব্যক্তিত্ব ছুঁয়ে আছে আকাশ পবন। আর যদি সে মন্দ, নিচুতা ও পাপ-অন্যায়ের ভাবনায় রত থাকে তাহলে সে কাঁটার দঙ্গল, পশুর চেয়ে অধম। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ৭৭৮-৮১২)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত