আইয়াজি (রহ.) আল্লাহর একজন খাঁটি অলি। আল্লাহর প্রেমে ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, জীবন উৎসর্গিত মানুষ। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘খোলা তরবারি নিয়ে উদোম গায়ে কম করে হলেও নব্বই বার যুদ্ধের মাঠে অবতীর্ণ হয়েছি। স্বপ্ন ছিল, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে প্রাণ দেব, শহিদের মর্যাদা লাভ করব। কিন্তু শাহাদত আমার ভাগ্যে জুটেনি। আমার শরীরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে কোনো আঘাত লাগেনি; সমস্ত শরীর চালনির মতো ছিদ্র ছিদ্র জর্জরিত হয়ে গেছে। অথচ প্রাণ হরণ করার মতো কোনো আঘাত আমার শরীরে লাগেনি। আমার বুঝে এসেছে, শহিদ হওয়া কপালে থাকতে হয়। চালাকি, বিচক্ষণতা দিয়ে এই সৌভাগ্য লাভ করা যায় না।’
‘চোন শহিদি রুজিয়ে জানাম নবুদ
রফতম আন্দর খালওয়াতো দর চিল্লাহ যুদ’
শাহাদাত যেহেতু আমার প্রাণের কপালে ছিল না
শুরু করলাম শেষে চিল্লা দেয়া, নির্জনা সাধনা।
যুদ্ধের ময়দানে শাহাদত বরণ আমার কপালে ছিল না- এ কথা বুঝতে পারার পর আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। তারপর শুরু করলাম একান্তে নির্জন সাধনা।
‘দর জিহাদে আকবর আফকান্দাম বদন
দর রেয়াযত কর্দন ও লাগর শোদান’
জিহাদে আকবরে নিয়োজিত করলাম দেহ
কৃচ্ছ্রসাধনায় দেহ ক্ষীণকায় করি দলিয়ে মোহ।
নফসে আম্মারাকে শায়েস্তা করার জন্য দেহকে নানারূপ ইবাদত, রেয়াজত ও সাধনার কসরতে জর্জরিত করতে লাগলাম। এ সময় গাজিদের তরফে ঢাক পিটানো হলো, চলো সবাই, যুদ্ধে চলো। দ্বীনের পথে সিপাহীরা সমবেত হও। শত্রুর প্রতিরোধে এগিয়ে চলো। তখন হঠাৎ আমার ভেতর থেকে নফস ডাক দিয়ে উঠল। ভোর রাতে মনের এ ডাক মনে হলো ইন্দ্রিয় কানেই শুনতে পাচ্ছি। কান পেতে শুনি, মন আমাকে বলে, যুদ্ধের এই আহ্বানে অবশ্যই তোমার সাড়া দেয়া চাই। রণাঙ্গণে তোমাকে অবশ্যই বীরত্বের সাক্ষর রাখতে হবে।
‘গোফতাম আই নফসে খবিসে বি ওফা
আয কুজা মেইলে গাজা তো আয কুজা’
বললাম, ওহে দুষ্ট ধোঁকাবাজ নফস আমার
যুদ্ধের জন্য কেন লালায়িত, তুমি কোথাকার?
মনকে বললাম, হঠাৎ তুমি ভালো হয়ে গেলে, ব্যাপার কি? তুমি তো বেওয়াফা প্রতারক। মানুষকে বিপথগামী করাই তোমার স্বভাব। মানুষের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু চাও না। কাজেই তোমার এমন আচরণের রহস্য কী। জিহাদের ময়দানে শত্রু নিধনে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছ, রহস্যটা আমাকে খুলে বলো।
নফস! আজ তোমাকে সত্য কথা বলতে হবে। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তোমার এই অনুপ্রেরণার পেছনে কোনো প্রতারণা অবশ্যই লুকিয়ে আছে। আমি তো তোমাকে ভালো করে চিনি। ইবাদত বন্দেগি সওয়াবের কাজে তুমি প্রেরণা যোগাতে পার না। এর রহস্য সহজে না বললে কী ওষুধ প্রয়োগ করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে, তা আমি জানি। কৃচ্ছ্রতার পর কৃচ্ছ্রতার কষাঘাতে তোমার চাহিদাগুলো তছনছ করে দেব। সুফি আইয়াজের এমন হুমকি শুনে নফসে আম্মারা ভেতর থেকে ডাক দিল। নফসের ডাকে শব্দ বা উচ্চারণ ছিল না বটে; কিন্তু মনের কানে খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। নফস বলল,
‘কে মারা হার রোজ ইনজা মি কুশি
জানে মন চোন জানে গাবরান মি কাশি’
রোজ তুমি হত্যা কর আমাকে তোমার দেহে
কাফেরের প্রাণের মতো নির্যাতন চালাও প্রাণে।
নফস বলল, তোমার নির্যাতনে আমি কীভাবে জর্জরিত হই, কেউ জানে না। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, ইবাদত-বন্দেগির কষাঘাতে খাওয়া-নাওয়া ভুলে অস্থির থাকতে হয় তোমার ইবাদতে সাড়া দিতে। কাজেই আমি যুদ্ধে যেতে চাই, জীবন দিয়ে তোমার হাত থেকে রেহাই পেতে চাই। তোমার কৃচ্ছ্রতার নির্যাতন থেকে বাঁচতে চাই। যুদ্ধে নিহত হলে তো একবারই হব। কিন্তু এখানে তোমার কৃচ্ছ্রতার নির্যাতনে দিনে কতবার যে নিহত হচ্ছি ইয়ত্তা নেই। কাজেই একবার নিহত হয়ে দিনে-রাতে শতবার নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে চাই।
বললাম, হে নফস, সত্যিই তোমার ভেতরে-বাইরে ধোঁকা আর ধোঁকা। তোমার মতো প্রতারক আর নেই। আমি এখন সিদ্ধান্ত নিলাম, নির্জন সাধনায় নফসের যত চাহিদা অস্বীকার করে চলব। এই পথে নফসকে শায়েস্তা ও আমার করায়ত্বে রাখব। কারণ, নির্জনতায় লোকচক্ষুর আড়ালে মানুষ যে ইবাদত করে তাতে প্রদর্শনেচ্ছা থাকে না। মানুষকে খুশি করা বা বাহবা কুড়ানোর মতলব কাজ করতে পারে না। তখন বান্দা মনে করে আমার সব কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন মহামহিম আল্লাহতায়ালা।
‘জুম্বে শো আরামেশ আন্দর খালওয়াতাশ
জুয বরায়ে হক নবাশদ নিইয়তাশ’
নির্জনতায় যত বিশ্রাম, তৎপরতা, সাধনা
আল্লাহ ছাড়া নিয়তে অন্যকিছু থাকে না।
‘ইন জিহাদে আকবরাস্ত আন আসগরাস্ত
হার দো কারে রুস্তুম ও হায়দার আস্ত’
এই জিহাদ আকবর শ্রেষ্ঠ ওটি ছোট তবে
উভয় কাজেই চাই বীর রুস্তুম ও হায়দার।
নির্জন সাধনায় অন্যায় কামনা-বাসনার বিরোধিতা করে নফসকে শাসন করা হলো জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ। আর রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই জিহাদে আসগর বা ছোট জিহাদ। শাহাদতের তামান্নায় যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে প্রাণটা আল্লাহর কাছে সঁপে দেওয়া যতখানি কঠিন, তার চেয়েও কঠিন হলো সব সময় নিজের নফসকে শাসন করে কামনা-বাসনার চাহিদা ও দাবি অস্বীকার করা, শরিয়তের অনুশাসন পরিপালন আর আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসা সর্বক্ষণ মনের মাঝে জাগরুক রাখা। তবে জিহাদে আকবর বা আসগরের জন্য চাই বীর রুস্তুম আর হজরত আলী হযায়দারের মতো মন ও সাহস। এই জিহাদ এমন কারও কাজ নয়, যে রাতের আঁধারে শয়নকক্ষে ইঁদুরের উৎপাত হলে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে সাধনার পথ ছেড়ে দেয়।
সুফি দুই প্রকার। একজন নামের সুফি, আরেকজন কামের সুফি। উভয়ের মাঝে নামের মিল থাকলেও একজন সূইয়ের ফোঁড়ায় কুপোকাত হয়ে যায়। আরেক সুফির হাতে তলোয়ার চমকায়। প্রথম প্রকারের উদাহরণ গেল সপ্তাহের গল্পে কাফের যুদ্ধবন্দির তীর্যক চাহনিতে হুঁশজ্ঞান হারানো ভণ্ডসুফি আর দ্বিতীয় প্রকারের সুফির নমুনা আইয়াজ (রহ.), যার পরিচয় ‘পাহাড় টলে তো ফকির টলে না’। কাজেই যে কারও গায়ে সুফির নামাবলি দেখে আমরা যেন প্রতারিত না হই।
আল্লাহতায়ালা আপন বন্ধু ওলিদের ব্যাপারে স্পর্শকাতর। তিনি চান না, যে কেউ তার অলিদের পরিচয় লাভ করুক। তাদের আসল অবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ তিনি যে কাউকে দেন না। তাই বাহ্যদর্শীদের দৃষ্টিশক্তি থেকে তাদের অন্তরালে রাখেন। ভণ্ড তাপস সুফিদের লোক দেখানো বুজরুকি, ডামাঢোল ও ধুমধাম থেকে তারা থাকেন আড়ালে আত্মগোপনে। ভণ্ডদের উদাহরণ, ফেরাউনের জাদুকরদের জাদুর সাপ, বড় লম্ফঝম্ফ করে। যখন আসল সুফিদের হাত থেকে মুসার (আ.) লাঠি বের হয়, ওদের বুজরুকির আসল চরিত্র ফাঁস হয়ে যায়। এরা নফসকে দমনের নামে আসলে নফসের পূজা করে ।
আরেকজন সুফির কথা বলি, যিনি ঈমানের দাবিতে অবিচল ছিলেন। মুসলমানরা যখন যুদ্ধে যান তিনিও তাদের সাথি হন আল্লাহর পথে জীবনবাজি রাখার ইচ্ছায়। একবার নয়, অন্তত বিশবার তিনি যুদ্ধে যান। তার ইচ্ছা আল্লাহর দ্বীনের জন্য কষ্ট স্বীকার করবেন, আহত হবেন, আল্লাহর ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন। এ কারণে মুজাহিদরা কখনো ময়দান থেকে পিছপা হলেও তিনি অবিচল থাকেন। শেষবারের আঘাতে তিনি মাটিতে বসে পড়েন। সেই বসার আসন ছিল ঈমানের দাবিতে সততার আসন। প্রেমের সততার গুণে তিনি লাভ করলেন আল্লাহর কাছের সততার সিংহাসন। সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এ ধরনের বান্দাদের জন্যই আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘মুত্তাকিরা থাকবে বাগান আর ঝর্ণাধারার মাঝে, প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদার স্থানে, সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারীর (আল্লাহ) কাছে।’ (সুরা কমার : ৫৪-৫৫)
সত্যনিষ্ট সিদ্দিকিন কারা? দ্বীনে সততা বলতে কী বুঝায়? সততা মানে নিজের প্রাণটা মুঠোয় নিয়ে আরশের মালিকের দিকে ছুঁড়ে দেয়া। এ কথার প্রমাণ জানতে হলে কুরআন মাজিদ থেকে পাঠ কর ‘রিজালুন সাদাকু’। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কিছু লোক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে (শাহাদাত বরণ) করেছে আর তাদের কিছু লোক অপেক্ষায় আছে। তারা (তাদের সংকল্প) কখনো তিল পরিমাণ পরিবর্তন করেনি।’ (সুরা আহজাব : ২৩)
মওলানার কাছে প্রশ্ন, আল্লাহর পথে যে কেউ মারা গেলে কী সিদ্দিকিনদের এই স্তরে পৌঁছে যাবে? মওলানা বুঝিয়ে বলেন, ‘তা কখনও নয়। যারা নফসে আম্মারাকে নিজের বশীভূত করতে পেরেছেন, তাদের জন্যই এই মাকাম। যারা দুনিায়াতে নফসে আম্মারার মরণ ডেকে এনেছেন, তারাই শাহাদত বরণের পর চিরন্তন জীবন লাভ করেছেন।’
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প, ৫খ. ব. ৩৭৮০-৩৮৩০)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)