ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/২)

বাসরঘরে দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
বাসরঘরে দুনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ

সে যুগে পয়সাওয়ালা বড় লোকদের বলা হতো খাজা। এক খাজার গোলামের নাম ছিল হিন্দি। জন্মে হিন্দুস্তানি হওয়ার সুবাদে তার নাম হিন্দি। হিন্দি গোলাম হলেও খাজা তাকে প্রতিপালন করেন ছেলের মতো আদর যত্নে। বিদ্যাবুদ্ধির আলো জ্বালান তার বুকে। মনিবের অযাচিত আদর যত্নে হিন্দির মন আক্রান্ত হয় অহমিকায়। অহংকার বশে সে নিজেকে কতকিছু ভাবতে থাকে।

খাজার এক মেয়ে ছিল খুবই সুন্দরী। তার রূপ ও গুণের খ্যাতি ছিল পাড়া-পড়শি, আত্মীয়-স্বজনের মুখে-মুখে। বিয়ের উপযুক্ত হলে চারদিক থেকে প্রস্তাব আসতে থাকে খাজা-কন্যার প্রার্থী হয়ে। অভিজাত ঘরের ছেলেরা প্রার্থী হয় মোটা অঙ্কের মোহরানার প্রস্তাব দিয়ে। কিন্তু খাজার এক কথা, আমার সম্পদ দিয়ে কী হবে। সম্পদ তো দিনে আসে রাতে ফুরিয়ে যায়। অভিজাত ছেলেদের বেলায় আরও মারাত্মক আপদ, এরা বাবার সম্পদের অহমিকায় বেসামাল হয়ে যায়। সম্পদ তাদের বিপথগামী করে মা-বাবা, বংশের জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে। শিক্ষিত নামি-দামি যুবকদের ক্ষেত্রে এই বিপদ কম নয়। শয়তান কি কম শিক্ষিত ছিল? সে ছিল ফেরেশতাদের শিক্ষক, মহাজ্ঞানী পণ্ডিত। কিন্তু তার একটি জিনিসের অভাব ছিল।

এলম বুদাশ চোন নাবুদাশ এশকে দ্বীন

উ নদিদ আজ আদম ইল্লা নকশে তীন

জ্ঞান ছিল তার, ছিল না দ্বীনের প্রেমের বাতি

আদমের মাঝে দেখেনি তাই মাটি ভিন্ন কিছু।

গরচে দানি দিক্কতে এলম আই আমিন

জান্ত নাগ্শায়দ দো দিদেয় গাইব বিন

যদিও তুমি জান জ্ঞানের খুঁটিনাটি হে বিশ্বাসী

সেই জ্ঞানে তোমার খুলবে না দুচোখ অদৃশ্যদর্শী।

ইবলিসের জ্ঞান ছিল; কিন্তু তার কাছে দ্বীনের প্রেম ছিল না। ফলে জ্ঞানের আলোতে আদমকে চিনতে পারেনি। মনে করেছে, আদম মাটির পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়। তুমিও জ্ঞানের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জান। কিন্তু সেই জানা তোমার দিব্যচক্ষু খোলার জন্য যথেষ্ট নয়। যারা জ্ঞানের গরিমায় দোল খায় তাদের কাছে তো পাগড়ি, দাড়ির দৈর্ঘ্য ও আচকানই বিবেচ্য। ডিগ্রি উপাধি পদকের বহর দিয়ে মানুষকে মাপে। অথচ মানুষের প্রকৃত পরিচয় অনেক গভীরে।

কার তাকওয়া দারাদো দ্বীন ও সালাহ

কে আজু বাশদ বে দো আলম পানাহ

আসল তো তাকওয়া, দ্বীনদারী, সৎকর্র্ম, সদাচার

উভয় জগতের কল্যাণ-সাফল্য বয়ে আনে বারবার।

্এসব বিষয় চিন্তা করে খাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, তার মেয়েকে একজন ধর্মপ্রাণ যুবকের কাছে বিয়ে দেবেন। কিন্তু নারী মহল থেকে আপত্তি এলো, হবু বরের তো ধন-সম্পদ, খ্যতি ডিগ্রি, বাইরের রূপ গড়ন আকর্ষণ নেই। খাজা বললেন, যার মধ্যে দ্বীনদারি আছে তার সবই আছে। দুনিয়া ও আখেরাতে সে সফল হবেই। কাজেই তার কাছেই দেব আমার মেয়ের বিয়ে।

একদিন ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজন দ্বীনদার ছেলের সঙ্গে খাজার মেয়ের বিয়ের ঠিক হলো। বরপক্ষ নিশানার আংটি পরাল মেয়ের হাতে। এমন আনন্দময় পরিবেশে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হলো। খবর ছড়িয়ে পড়ল, সবচে কর্মঠ প্রিয় গোলাম হিন্দি অসুস্থ। এক দুই দিন নয়, দিন দিন তার অসুস্থতা বাড়তে লাগল। নানা চিকিৎসা দিয়ে ফলোদয় হলো না। খাজার সন্দেহ জাগল, কোনো মনোরোগে সে আক্রান্ত হলো কিনা। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলেন, দেখ তো, হিন্দি দিনদিন কঙ্কালসার হওয়ার কারণটা উদ্ঘাটন করতে পার কি না। বাড়িঘরের কাজকর্ম সংসার যে অচল হয়ে পড়ল।

খাজার স্ত্রী একান্তে ডেকে গোলামের সঙ্গে কথা বললেন। মায়ের আদর দিয়ে তার মনের তালা খুলে ফেললেন। হিন্দি বলল, আমি আপনাদের ছেলের আদরে বড় হয়েছি, আছি। আমি ভাবতেই পারছি না আপনার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেবেন। মনিবের মেয়ের আদর-যত্নের অধিকার তো আমারই। তাকে বিয়ে করে অন্য কেউ আপনাদের অপন হয়ে যাবে, তা আমি মেনে নিতে পারছি না।

গোলামের এমন স্পর্ধা দেখে খাজা-পত্নীর আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। কোন নচ্চার হিন্দির ছেলে আমার মেয়ের প্রতি লালসা করবে, এক্ষুণি তাকে কেটে টুকরো টুকরো করব কি না! তবে বুকে ধৈর্যের পাথর চেপে বললেন, খাজাকে এর বিচার অবশ্যই করতে হবে।

স্ত্রীর মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে খাজার মাথায় আগুন ধরে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এ মুহূর্তে ধৈর্যের বিকল্প নেই। স্ত্রীকে সান্ত¡না দিলেন, গোলামকে এ মুহূর্তে ভর্র্ৎসনা করতে যেও না। তাতে আমাদেরও বদনাম ছড়াতে পারে। আমি এমন কৌশলে কাজ করব ‘শলাকা পুড়বে না, কাবাবও কাঁচা থাকবে না’। ‘সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না’। গোলামের বাচ্চার বাপ-দাদার নাম ভুলিয়ে দেব।

তুমি হিন্দির কাছে গিয়ে বল, আমরা আগে জানতে পারলে এমনটি হতো না। এখন তোমার সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে দেব। ওই বরকে দেব না। তাতে সে নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠবে। স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। কারণ, ভালো ও সুন্দর চিন্তা মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য বয়ে আনে। জানোয়ার মোটাতাজা হয় ঘাসের খাবার, খড়ের জোগান পেলে। মানুষ মোটাতাজা হয় সম্মান ও ইজ্জত পেয়ে মস্তিষ্ক উর্বর হলে।

স্ত্রী বলল, কোন নচ্চার প্রেতনির ছেলে হিন্দি গোলাম। আমার মেয়ের ব্যাপারে এত বড় স্পর্ধা দেখালো, আমি কীভাবে তার সঙ্গে কথা বলব। তার চেয়ে ওকে ওভাবে মরতে দিন। ইবলিসের বেঁচে থাকার কী অধিকার আছে। খাজা বললেন, ভয় পেয়ো না, সামান্য মুখের কথায় যদি তার চিকিৎসা করা যায় লাভটা তো আমাদের। তার বাকি ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। অগত্যা নারী হিন্দির কাছে কথাগুলো বলল শান্তভাবে।

মেয়ের মায়ের প্রস্তাব শুনে হিন্দির মনে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। উর্বর পলি জমিতে কিশলয় পল্লবিত হওয়ার মতো হিন্দি সুস্বাস্থ্য ফিরে পেল। খাজা একদিন বিয়ের মজলিস ডাকলেন বাছাই করা কিছু মেহমান নিয়ে। খাজার মেয়ের সঙ্গে তার গোলামের বিয়ে। মহাধুমধাম চারদিকে। কেউ কেউ টিপ্পনি কাটে হিন্দিকে নিয়ে। রাত এলে বাসরঘরে পাঠানো হলো শশ্রুবিহীন মেয়েলি চেহারার এক লোককে নবুবধূরূপে সাজিয়ে। বাসর ঘরের বাতি নিভিয়ে বাইরে শুরু হলো গান-বাজনার হৈহুল্লোড়। একটু পরেই হিন্দি বুঝতে পারে এ তো বউ নয়, আস্ত ষাঁড়। জেলখানায় নতুন কয়েদির মতো তার জীবনের ওপর শুরু হলো ঝড়-তুফান, ভয়াবহ অত্যাচার। বাইরের হট্টগোলে তার ফরিয়াদ আর্তনাদ শোনার কেউ নেই।

ভোর হলে রেওয়াজ মতো নতুন বরকে নেওয়া হলো হাম্মামে। অপমান অত্যাচারে বিধ্বস্ত হিন্দি নির্বাক। গোসল শেষে বাসরঘরে আনা হলে দেখে, রূপসী খাজা-কন্যা বসে আছে অপরূপ সাজে। মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তায় পাশে অবস্থান করছেন মা। নববধূর দিকে বার কয়েক তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হিন্দি মনে মনে বলে, দিনে তোমার রূপসী মায়াবি রূপ, অথচ রাতে হিংস্র জানোয়ার, নেকড়ের স্বভাব। দুহাতের ইশারায় হিন্দি জানিয়ে দিল: আমি তোমাকে চাই না। তোমার মত দুষ্ট বউ যেন কারও কপালে না জুটে।

এই গল্প দুনিয়ার স্বরূপ বুঝানোর প্রতীকী কাহিনি। বাইরে থেকে দেখলে দুনিয়াকে মনে হবে লোভনীয় সুখের জান্নাত। কিন্তু দুনিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে বেসামাল হলে দেখবে তা জাহান্নাম।

হামচেনান জুমলা নায়িমে ইন জাহান

বস খোশাস্ত আজ দূর পিশাজ এমতেহান

অনুরূপ এই পৃথিবীর সকল নেয়ামত সামগ্রী

দূর থেকে লোভনীয় পরীক্ষার আগে দেখ যদি।

মি নামায়দ দর নজর আজ দূর আব

চোন রবি নজদিক বাশদ অন সরাব

দূর থেকে দেখে মনে হবে পানি জলমহাল

কাছে গিয়ে দেখ মরু-মরিচিকা মায়াজাল।

গান্দা পির আস্ত উ ওয়া আজ বস চাপলুস

খেশরা জলওয়া কুনাদ চোন নো আরুস

দুনিয়া সে বুড়ি, গায়ে দুর্গন্ধ ছড়ায় প্রতারক, তবু

নিজেকে সাজিয়ে দেখায় তোমায় রূপসী নতুন বধূ।

দুনিয়ার চাকচিক্য, রংরূপ লোভনীয় জৌলুসের সামনে তুমি ধৈর্যের পরীক্ষা দাও। নিজেকে সামলে রাখ, সংযমী তাকওয়ার জীবন অবলম্বন কর। তাহলে হিন্দির মতো তোমাকে দুর্দশার শিকার হতে হবে না। জেনে রাখ, অহংকার ও লোভ-লালসার শিকার শুধু হিন্দি হয়নি; মন্ত্রী, আমির, রাজা-বাদশাহ যারা ক্ষমতার লোভে অন্ধ প্রলুব্ধ তাদের কপালেও আছে একই দুর্দশা। এর থেকে রেহাই পাওয়ার পথ-

বন্দা বাশ ও বর জমিন রও চোন সমন্দ

চোন জানাজাহ নাহ বর গর্দান বরান্দ

অনুগত বান্দা হও, অশ্বের মতো হও জীবন সংগ্রামী

লাশের মতো অন্যের কাঁধে বোঝা হইও না তুমি।

নাফরমানরাই চায়, লোকেরা তার অনুগত হয়ে থাকুক, খেদমত করুক, নিজে লাশবাহী কফিনের মতো অন্যের কাঁধে বোঝা হয়ে জীবন অতিবাহিত করুক। রাজা হোক বা প্রজা, যে নিজের কাজ নিজে না করে অন্যকে খাটায় তার উপমা মরা লাশ। এ ক্ষেত্রে মওলানার উপদেশ-

বারে খোদ বর কাস মানেহ বর খিশ নেহ

সরওয়ারি রা কম তলব দরবিশ বেহ

নিজের বোঝা চাপিও না অন্যের ঘাড়ে নিজের ওপর নাও

নেতৃত্ব সন্ধানী হইও না, দরবেশি জীবন উত্তম বেচে নাও।

মানুষের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে চলার অভ্যাস ছাড়, নচেৎ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই পা তোমার অচল হয়ে যাবে। এ জন্যই আল্লাহর নবী বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে যদি জান্নাত চাও, কারও সাহায্যে চলার মনোবৃত্তি ছেড়ে দাও।’ আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক : ৩)।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৫, বয়েত : ২০৯-২৩৮)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

বাসরঘর,মওলানা রুমি,মসনবি শরিফ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত