ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়

ড. খালেদ বিন সুলাইমান আল মুহান্না
আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়

বান্দার জন্য তার প্রভুর কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম ও সর্বোত্তম উপায়, আল্লাহ যে ফরজ ইবাদতগুলো বান্দার ওপর বাধ্যতামূলক করেছেন, সেগুলো আদায় করা। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা হাদিসে কুদসিতে বলেন, ‘আমার বান্দা যা দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হলো, যা আমি তার ওপর ফরজ করেছি। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে।’ (বোখারি : ৬৫০২)। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়বিষয় হলো, তার ইবাদতে একমাত্র তাকে উদ্দেশ্য করে, তার জন্যই ধর্মকে খাঁটি রাখা। এটিই আল্লাহর বান্দাদের ওপর সবচেয়ে বড় ফরজ। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ হলো, শিরক বা তার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করা। এটা হলো সেই গর্হিত কাজ, যা আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

বান্দাকে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে নামাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সাবধান! তুমি এর অনুসরণ করো না এবং সেজদা করো ও আমার নিকটবর্তী হও।’ (সুরা আলাক : ১৯)। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটে থাকে যখন সে সেজদায় থাকে। তাই বেশি বেশি দোয়া করো।’ (মুসলিম : ৯৭০)। এমন হওয়ার কারণ হলো, নামাজে সেজদা হচ্ছে বান্দার দাসত্ব ও বিনয় প্রকাশের চূড়ান্ত রূপ, আর আল্লাহর জন্য তা হলো সর্বোচ্চ সম্মান ও মহিমা প্রকাশ। আল্লাহর মহিমা এতটাই মহান যে, তার কোনো তুলনা নেই। সুতরাং, মানুষ যতই অহংকার ও গর্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখবে, বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে সেজদায় লুটিয়ে পড়বে, সে ততই আল্লাহর জান্নাতের নিকটে পৌঁছে যাবে, তার সান্নিধ্য লাভ করবে।

একজন বান্দার প্রভুর প্রতি তার বিনয় ও দাসত্বের সত্যতার প্রমাণ দুটি বিষয়ে প্রকাশ পায়। প্রথমত, সে তার প্রভুর আদেশ-নিষেধে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেয়, তার ফয়সালায় ধৈর্যধারণ করে ও নম্র হয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত, সে নিজের ভেতর থেকে অহংকারের পোশাক খুলে ফেলে, আত্মতুষ্টি ও আত্মগরিমার আবরণ ছুঁড়ে ফেলে দেয় ও বিনয়ের পোশাক পরিধান করে, নিজেকে ভেঙে চুরে ফেলে।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, ‘যত বেশি বান্দা আল্লাহর দরবারে নিজেকে অপারগ, অসহায়, বিনয়ী ও দ্বীন মনে করবে, ততই সে আল্লাহর কাছে অধিক নিকটবর্তী ও মর্যাদাবান হবে।’

আল্লাহর প্রতি যিনি সত্যিকার ভালোবাসা রাখেন, তিনি ফরজ ইবাদতের পর নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর আরও কাছে যেতে থাকেন। তিনি ফরজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নফল, মুসতাহাব ও উত্তম কাজগুলোও করেন। এভাবে তিনি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর এতটাই নিকটে পৌঁছান যে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন।

আর যাকে আল্লাহ ভালোবাসেন, তিনি তার বন্ধু ও সাহায্যকারী হয়ে যান। তখন আল্লাহ তার কানকে হারাম শোনা থেকে রক্ষা করেন, চোখকে হারাম দেখা থেকে রক্ষা করেন, হাতকে জুলুম ও অন্যায় থেকে রক্ষা করেন, আর পা দিয়ে যেন সে আল্লাহর অসন্তুষ্টির দিকে চলে না যায়- সে দিক থেকে রক্ষা করেন। বরং সে পা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলে। এতে করে তার মন-প্রাণ পবিত্র হয়ে যায়, হৃদয় বিশুদ্ধ হয় এবং সে আসমান ও জমিনের প্রভুর কাছাকাছি চলে যায়, তার দোয়া কবুল হতে থাকে। এ কথাগুলোর প্রমাণ আল্লাহর একটি পবিত্র হাদিসে পাওয়া যায়, যেখানে তিনি বলেন, ‘আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার কাছে আসতেই থাকে, যতক্ষণ না আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে শোনে, চোখ হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে ধরে ও পা হয়ে যাই, যেটা দিয়ে সে হাঁটে। যদি সে কিছু চায়, আমি তাকে দিই; আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, আমি তাকে আশ্রয় দিই।’ (বোখারি : ৬৫০২)।

একজন বান্দা যতই আল্লাহর কাছে আগাতে থাকে, আল্লাহও তাকে ততই কাছে টেনে নেন এবং তাকে এমন এক সুসংবাদ দেন, যা শুনলে আত্মা আনন্দে ভেসে যায়। যখন সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে প্রশান্তি, বিশ্রাম, পরিপূর্ণ সুখ ও সম্মানজনক রিজিক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি সে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন হয়, তবে তার জন্য রয়েছে আরাম, উত্তম জীবনোপকরণ ও সুখদ উদ্যান।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৮৮-৮৯)

আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার এই পথ ধরেছিলেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দারা। তারা সৎকর্ম দিয়ে তার সান্নিধ্য কামনা করেছিলেন, আর তারা আল্লাহর সঙ্গে করা অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন। তাই আল্লাহও তাদের কাছে টেনে নিয়েছেন, তাদের এমন উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন, যার কাছাকাছি আর কেউ যেতে পারে না। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর কাছে ছিলেন মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) ও ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহ তাদের দুজনকেই তার বন্ধু বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ ইবরাহিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন।’ (সুরা নিসা : ১২৫)। আর মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি যদি আমার উম্মতের কাউকে বন্ধু বানাতাম, তবে আবু কুহাফার পুত্র আবু বকরকে বানাতাম; কিন্তু তোমাদের নবী হচ্ছেন আল্লাহর বন্ধু।’ (মুসলিম : ৬০৬৯)। আল্লাহ তাদের দুজনের রুহকে বরজখে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্থান দিন এবং জান্নাতেও তাদের মর্যাদা উঁচু রাখুন।

আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের আমল গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সঠিক পথ কী। তিনি বলেছেন, ‘আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো কাছেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দিই।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)।

আল্লাহ সবকিছু জানেন। আকাশ ও জমিনের কোনো কিছুই তার অজানা নয়। মানুষ যত ভাষায়, যত দরকার নিয়ে তাকে ডাকে, সব শুনতে পান, কোনো কিছুর শ্রবণ অপর কিছুর শ্রবণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কেউ বারবার ডাকলেও তিনি বিরক্ত হন না, প্রশ্ন ভুল করে করলেও বিভ্রান্ত হন না। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে সবকিছু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এমন কিছু বাকি রাখিনি, যা তোমাদের আল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে পারে, আর তোমাদের তাতে আদেশ দিইনি।’ তাই আল্লাহর কাছে চাওয়ার একমাত্র সঠিক উপায় হলো, আল্লাহ যা তার কিতাবে বলেছেন অথবা রাসুল (সা.) যেভাবে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সেভাবে তার কাছাকাছি যাওয়া। যে কেউ অন্য কোনো পদ্ধতি বা মাধ্যম গ্রহণ করে, তার সে চেষ্টা বাতিলযোগ্য; বরং তা তাকে আল্লাহ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করবে, যা আমাদের ধর্মে নেই- তা প্রত্যাখ্যাত।’ (মুসলিম : ৪৩৮৫)

ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে সরল ও নিরাপদ মাধ্যম তিনটি- এক. সুন্নাহর ওপর অটল থাকা; অন্তরে ও বাইরে। দুই. সবসময় আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল থাকা। তিন. কাজ ও কথায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য রাখা। এই তিনটি ছাড়া কেউ আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দা হতে পারেনি। যদি কেউ আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাহলে এই তিনটি বিষয় ছেড়ে দেওয়ার কারণেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে।’

অনুবাদ : আবদুল কাইয়ুম শেখ

আল্লাহর নৈকট্য
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত