ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ট্রেনে কমেছে মালামাল পরিবহন

ভালো নেই ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনের কুলিরা

ভালো নেই ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনের কুলিরা

বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস। প্রতিবছরই শ্রমিক দিবস আসে কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন নেই ব্রিটিশদের তৈরি দেড়শ বছরের পুরনো ঈশ্বরদী জংশন রেলস্টেশনের কুলিদের। সবার পরনে লাল রঙের হাফ হাতা শার্ট। আব্বোত আলী (৫৩) নামের এক কুলির কাঁধে গামছা, হাঁটছেন ঈশ্বরদী রেল প্ল্যাটফর্ম–জুড়ে। জামাটিও বিভিন্ন স্থানে ছিঁড়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের যাত্রী– ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে পুরো স্টেশন দেখেন লালন নামের আরেক কুলি। এসব কুলিদের জীবন-জীবিকায় দুর্দিনের চিত্র আব্বোত আলী নামের কুলির শরীরেই ভেসে ওঠে। ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার কেউবা ট্রেন যাত্রীর মালামাল মাথায় নিয়ে ওভার ব্রিজ পার হচ্ছেন ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ও বাইরে। উদ্দেশ্য কোনো যাত্রীর সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মালামাল ওভারব্রিজ পার করে প্লাটফর্ম নিয়ে ট্রেন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া বা ট্রেন থেকে নামা যাত্রীর জিনিসপত্র ওভারব্রিজ পার করে স্টেশনের বাইরে এনে দেওয়া। বিনিময়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পাওয়া। সবাই তাদের লাল কুলি বলেই ডাকেন। এক সময়ে প্রায় ৮০ থেকে ১০৫ জন কুলি কাজ করেন এ স্টেশনে।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজের পূর্ব পাশে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড চত্বরে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো এসব মানুষের। সবাই চেষ্টা করছেন প্রাইভেটকার, সিএনজি, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আসা যাত্রীদের জিনিসপত্র নিজের মাথায় তুলে নিয়ে ওভারব্রিজ দিয়ে প্লাটফর্মের ট্রেন পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার। ত্রিশ বছর আগেও ট্রেন এলে মালামাল ওঠানামায় ব্যস্ত সময় পার করতেন আব্বোত আলীর মতো অন্তত ৮০ জন কুলি। কিন্তু এখন তা অতীত। ট্রেন ও রেলপথে মালামাল পরিবহন কমতে থাকায় কুলিরাও অভাব অনটনে পড়ে কেউ কেউ পেশাবদল করছেন।

এদিকে এক সময় যখন স্টেশন এলাকায় থাকতো যাত্রীদের ভিড় ও মালামাল । এসময় কুলিদের আয়ও ভালো হতো। তারা বলছেন, ‘আগের মতো আয় নেই। যাত্রীদের বেশিরভাগই নিজেদের জিনিসপত্র নিজেরাই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে যাচ্ছেন। যারা কুলির সহায়তা নেন তারাও বেশি টাকা দিতে চান না।’

দীর্ঘদিন কুলির কাজ করা এসব শ্রমিক বলছেন, ‘অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা এ কাজ করেন। কেননা দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় থাকায় তারা আর পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না। আবার অনেকের বয়স বেশি হওয়ায় নতুন কোনো কাজও করতে পারেন না। সারাদিন কাজ করে যা আয় হয় তাতে সংসার চালানোই কষ্টকর।’

লোকাল ট্রেনগুলোতে আগে অনেক ধরনের মালামাল পরিবহন করা হতো। পুরো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মালামালের জন্য চলাচল করা যেত না। কিন্তু সড়কপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায়, ছোট ট্রাকে, ছোট পিক আপ ভ্যানে করে মালামাল দোকান পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে। লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মালামাল পরিবহন কমে গেছে। এখন একদম কাজ নেই। বর্তমানে স্টেশনে প্রতি শিফটে ১৪ জন করে দুই শিফটে ২৮ জনের মতো কুলি আছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যা কামাই করি, বাজারে গেলে দেহি জিনিসের দাম আরও বেশি। অনেক কষ্টে দিন পার করছি। এই বয়সে অন্য পেশায় যাব, সে সুযোগও নেই। প্রথমে যে টাকা পাইতাম, তা দিয়ে ভালোভাবে চলা যাইত, এখন যা পাই তা দিয়ে সংসার, ছেলে মেয়ের লেখাপড়া চলে না।

দীর্ঘ আট বছর ধরে ঈশ্বরদী জংশন রেলওয়ে স্টেশনে কুলির কাজ করেন ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের সাজদ্দি। তিনি জানান, স্টেশনে চব্বিশ ঘন্টায় ১২ ঘন্টা করে দুই শিফটে কুলিদের কাজ চলে। প্রথম শিফটের কাজ শুরু হয় দুপুর ২ টা থেকে পরদিন দুপুর ২ টায় শিফট শেষ হয়। আবার পরবর্তী শিফট দুপুর দুইটা থেকে পরের শিফটের কাজ শুরু হয়। বেশ আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘গরিব মানুষ আমরা। কিছু কইরা তো খাইতে হইবো। সারাদিন রাত ১২ ঘন্টা শিফট খাইটা চারশ থেকে পাঁচশত টাকা ইনকাম করি। কোনো দিন সেটাও হয় না। করোনার সময় থাইকা আমাদের কষ্ট বাড়ছে।’ এখন সংসার চালাইতেই জীবন যায়।’

মিনহাজ নামের আরেক কুলি বলেন, ‘ইনকাম কমে গেছে। লোকজন যা আসে নিজেগো মালামাল নিজেরাই নিয়ে যায়। আমাগোরে টাকা দিতে চায় না। দিলেও ৪০-৫০ টাকা দিবার চায়। বৌ-পোলাপান নিয়ে চলাই কষ্ট।’

ইউসুফ নামের আরেক কুলি বলেন, ‘আয়-রোজগার তেমন নেই। কষ্টের সংসার, কষ্টেই চলে।’

পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, উত্তর দক্ষিণ ও পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ব্রিটিশরা প্রায় ১১০ বছর আগে ১৯১৫ সালের যাত্রা শুরু হয় দেশের অন্যতম ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশনের। সে সময় এই জংশন স্টেশন হয়ে অনেক যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতো। বর্তমানে ২৪ ঘন্টায় এই জংশন স্টেশন হয়ে ১২ টি আন্তঃনগর ট্রেন, ৪টি মেইল ট্রেন এবং ৪টি লোকাল ট্রেন চলাচল করে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় ট্রেনকেন্দ্রিক বাণিজ্য ছিল রমরমা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসত কৃষিপণ্য। পাশাপাশি ভারী মালামালও পরিবহন করা হতো; কিন্তু লোকাল ট্রেন বন্ধ ও বিভিন্ন স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাটা পড়েছে রেলকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহনে। ফলে বেশির ভাগ সময়ই বেকার বসে থাকেন স্টেশনের লাল কুলিরা। এক দশক আগেও ৫০-৬০ জন কুলি স্টেশনে কাজ করতেন। মালামাল আসা কমে যাওয়ায় অনেক কুলি পেশা বদল করেছেন, বেছে নিয়েছেন সহজলভ্য পেশা; কিন্তু আদি পেশা আঁকড়ে এখন কিছু কুলি চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকেন ট্রেন আসবে, মালামাল ওঠানামা করাবেন এই অপেক্ষায়।

ঈশ্বরদী জংশন,স্টেশন,কুলি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত