রংপুরে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন বালিকা কেন্দ্রে মেয়ে শিশুদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের বিষয়ে আদালতে লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন নিবাসী রিতু।এ ঘটনায় স্ব-প্রণোদিত হয়ে আদালতে মামলা করা হয়েছে। পিবিআইকে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত রংপুর সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) মেয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি আমলে নিয়েছে আদালত। গত ২৯ জুন রংপুর মেট্রো কোতয়ালী সিআর আমলী আদালতের বিচারক অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদ হোসাইন স্ব-প্রণোদিত হয়ে মামলা দায়ের করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৬ জুন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পাঠ ও পর্যালোচনাকরে দেখা যায়, রংপুর সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন (বালিকা) কেন্দ্রে মেয়েদে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে জীবন বাঁচাতে ৪ কিশোরী পালিয়ে যায়। পূনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরতরা ভুক্তভোগী কিশোরীর চুল কেটে দেয় এবং কেন্দ্রের অনিয়মের কথা গোপন রাখতে তাকে চাপ প্রয়োগ করে। ভুক্তভোগী কিশোরীর মা তাকে দেখতে গেলে পূনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দূর্ব্যবহার করেন। এছাড়া গত ১২ জুন ৪ কিশোরী নিখোঁজ হলেও এখনও ২ জন কিশোরীর সন্ধান মেলেনি। এমন অবস্থায় জনস্বার্থে ও ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে রংপুর সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন কেন্দ্র থেকে ৪ কিশোরী পালানোর কারণসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া আবশ্যক মর্মে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনা বিষয়ে তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ প্রদান করেন আদালত। আগামী ২৯ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে নিখোঁজের ২১ দিন পর গত ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে রংপুর সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন কেন্দ্রের (বালিকা) নিবাসী রিতু আদালত চত্ত্বরে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে পুনরায় নির্যাতনের কবলে না পড়তে আদালতের মাধ্যমে নিরাপদ স্থানে তাকে রাখার আবেদন করেছেন। আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মীরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের কাছে তাকে হস্তান্তর করেন। পিবিআই রিতুকে জিজ্ঞাসাবাদসহ নিরাপদ স্থানে রাখার কথা জানিয়েছে।
এর আগে, গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে রিতু আক্তার বলেন, সমাজসেবা কার্যালয় ও রংপুর সমন্বিত শিশু পূনর্বাসন কেন্দ্র (বালিকা) কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতি সপ্তাহে বাহির থেকে বিভিন্ন পুরুষ এই কেন্দ্রে আসে। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন মেয়েদের ধর্ষণ করতো বহিরাগতরা। গত ১৫ জুন আমাকে ধর্ষণের তারিখ ছিল এবং পরবর্তী তারিখ গুলোতে অন্য নিবাসীরা ধর্ষণের শিকার হতো। বিষয়টি জানতে পেরে সুযোগ বুঝে পূনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্মৃতি, কৃতি ও আশাসহ আমি পালিয়ে যাই এবং প্রত্যেকে যে যার মত জায়গায় থাকে। আমি আমার এক পরিচিত আন্টির বাসায় আশ্রয় নেই। যেহেতু পুলিশ আমাকে খুঁজছে, তাই আমি আদালত চত্ত্বরে এসে আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মীদের সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আমাকে নিরাপদ স্থানে রাখতে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আমি সেন্টারের শিশুদের সাথে অত্যাচারকারী এবং সেন্টারের সকল কর্মকর্তাদের বিচার চাই।
পিবিআই রংপুরের পুলিশ পরিদর্শক মিন্টু চন্দ্র বণিক সাংবাদিকদের জানান, আদালতের একটি মিস কেস আমাদের হাতে এসেছে। রংপুর সমন্বিত শিশু পূনবার্সন কেন্দ্র (বালিকা) থেকে ৪ জন ভিকটিম মিসিং হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে তাদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩ জন উদ্ধার হয়েছে। এরমধ্যে উদ্ধার হওয়া নিবাসী রিতু মনিকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করবো এবং তদন্ত করে প্রতিবেদন আদালতের কাছে জমা দেব।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জোবাইদুল ইসলাম বলেন, সমাজসেবা কার্যালয়ের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠান রংপুর সমন্বিত শিশু পূণবার্সন কেন্দ্রে আঠারো বছরের নীচে শিশুদের রাখা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে মেয়ে শিশুদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন হয়েছে। এনিয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোন এ্যাকশন নেয় নাই। যে সমস্ত শিশুদের আত্মীয়-স্বজন ছিলনা, তারা নির্যাতনে মারা গেলে তাদের বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। কারো ময়না তদন্ত হয়নি। আমি মনে করি আদালত যেহেতু বিষয়টি আমলে নিয়েছে এবং পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এ থেকে সত্য বের হয়ে আসবে এবং মেয়েদের নির্যাতনের সাথে যত বড়ই কর্মকর্তা জড়িত থাক না কেন তারা আইনের আওতায় আসবে।
উল্লেখ্য, নগরীর দেওডোবা ডাংগীর পাড় এলাকার রংপুর সমন্বিত শিশু পূনবার্সন কেন্দ্রে গত ১২ জুন রাত থেকে নিখোঁজ হন নিবাসী নিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামে চার কিশোরী। ১৫ জুন পরিবারের সদস্যরা স্মৃতি ও কৃতিকে নগরীর চিড়িয়াখানা এলাকা থেকে উদ্ধারকরে পুলিশকে জানায়। পরে পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে পূনরায় পূনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠায়। এ ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা উদ্ধার হওয়া কিশোরীদের পূনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। আপত্তির কারণ হিসেবে পূনর্বাসন কেন্দ্রে মেয়ের উপর নির্যাতন ও তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শঙ্কিত বলে গণমাধ্যমকে জানান। এ ঘটনায় ২৫ জুন আদালতের মাধ্যমে স্মৃতিকে নিজ জিম্মায় নেয় পরিবারের সদস্যরা। নিবাসী স্মৃতি অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমে কথা বলার কারণে পূনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্তরা তার উপর মানসিক নির্যাতনসহ তার চুল কেটে দিয়েছে। এদিকে পূনর্বাসন কেন্দ্রের নিবাসী আশা এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে।