ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজার সীমান্তে মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য, বিজিবির প্রতিরোধযুদ্ধ

কক্সবাজার সীমান্তে মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য, বিজিবির প্রতিরোধযুদ্ধ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত কক্সবাজার—যেখানে সোনালি সৈকতের সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের চোখে স্বপ্ন বুনে দেয়, সেই একই ভূখণ্ডের সীমান্তে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর মাদক সাম্রাজ্য। ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ, হেরোইনসহ নানা নেশাজাত দ্রব্য প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মূল্যে প্রবেশ করছে এই পথ দিয়ে। এ প্রবাহ কেবল তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে না, বরং দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ভিত্তিও নড়বড়ে করছে।

‘রেড করিডর’ গোপন প্রবেশদ্বার

মিয়ানমারের মংডু থেকে ট্রলারে করে মাদক আসে নাফ নদীর মাঝপথ পর্যন্ত। সেখান থেকে ছোট ডিঙি নৌকা বা স্পিডবোটে তা দ্রুত পৌঁছে যায় টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্ত ঘাটে। পাহাড়ি গহ্বর ও কাঁচা রাস্তার আড়ালে গোপন পথে প্যাকেটগুলো ঢুকে পড়ে অভ্যন্তরীণ গুদামে। রাজধানীসহ বড় শহরে পৌঁছাতে ব্যবহার হয় পিকআপ, মাইক্রোবাস এমনকি অ্যাম্বুলেন্স। পাচারকারীরা মোবাইলে কোড ভাষা ব্যবহার করে ‘প্যাকেজ’, ‘মাছ’ বা ‘সিগারেট’ যার অর্থ ভয়ঙ্কর নেশা।

চক্রের চার স্তরের নেটওয়ার্ক

মাদক সাম্রাজ্যের পেছনে রয়েছে বহুমুখী কাঠামো। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের মাদক সম্রাটরা আড়ালে থেকে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এপারে স্থানীয় ফিনান্সাররা বিনিয়োগ করে দেশের বড় শহরে সরবরাহের ব্যবস্থা করে। এরপর পাইকারি পরিবেশকেরা গুদাম ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে, রুট বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলে। সর্বশেষ ধাপে খুচরা বিক্রেতারা শহরের অলিগলিতে পৌঁছে দেয় মাদক। অর্থ, অস্ত্র ও প্রভাবের জোরে চক্রটি বছরের পর বছর টিকে আছে।

সমাজে অদৃশ্য ক্ষত

মাদক ব্যবসা সমাজের শিরায় বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কালো টাকার পাহাড় বৈধ অর্থনীতিকে বিকৃত করছে, শিক্ষার্থীরা নেশায় হারিয়ে গিয়ে স্কুল-কলেজের বেঞ্চ ফাঁকা হচ্ছে। অপরাধ বাড়ছে, পারিবারিক সহিংসতা ও বিচ্ছেদও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সমাজকর্মীর ভাষায়, ‘মাদক শুধু একজন যুবককে নয়, তার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে।’

বিজিবির অভিযান ও সাফল্য

২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজার রিজিয়ন বিজিবি উদ্ধার করেছে ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি ইয়াবা, ৩৮১ কেজি ক্রিস্টাল মেথ, ২৫ কেজি হেরোইন, ৫২ কেজি গাঁজা, হাজার হাজার ক্যান বিদেশি বিয়ার, বোতলভর্তি মদ, কোকেন ও আফিম—যার বাজারমূল্য প্রায় ৮৯৩ কোটি টাকা। নগদ ১২ কোটির বেশি জব্দ এবং ২,৬৩৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছে, যাদের মধ্যে বহু পাকা পাচারকারী রয়েছে।

বিজিবি কর্মকর্তারা জানান, দুর্গম ভূগোল, স্থানীয় সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা লড়াইকে কঠিন করছে। তবে নজরদারি ড্রোন, থার্মাল ক্যামেরা ও স্পিডবোট ব্যবহার করে পরিস্থিতি বদলানোর চেষ্টা চলছে।

জনসম্পৃক্ততার প্রয়োজন

বিজিবির মতে, মাদকবিরোধী যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের নয়, মানুষের যুদ্ধ। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া এ লড়াই সম্ভব নয়। তাই স্কুল-কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি, জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অঙ্গীকারের মঞ্চ

১৩ আগস্ট কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির প্রশিক্ষণ মাঠে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে মাদকবিরোধী সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আকসার খান।

অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সবার কণ্ঠে ছিল এক প্রতিজ্ঞা—যত কঠিনই হোক, সীমান্তের অন্ধকার মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংস করতেই হবে।

বিজিবির প্রতিরোধযুদ্ধ,মাদকের অন্ধকার সাম্রাজ্য,কক্সবাজার সীমান্ত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত