
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা উখিয়া-টেকনাফের সংসদীয় আসনে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। নতুন ও পুরাতন সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে ইতিমধ্যে গ্রামাঞ্চলের আড্ডা কিংবা শহরের চায়ের দোকানে তুমুল আলোচনা চলছে। পাড়া-মহল্লায় ভোট প্রদান নিয়ে চলছে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে কোন দলের প্রার্থী শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবেন—এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর থেকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কক্সবাজার-০৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। এ আসনে ৮ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম নিয়ে আলোচনায় সরব ভোটাররা।
তারা হলেন— কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি, চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জেলা আমীর অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী, কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, আমার বাংলাদেশ পার্টির কেন্দ্রীয় রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ক সম্পাদক ও দৈনিক ইনকিলাবের কক্সবাজার ব্যুরো চীপ সাংবাদিক শামশুল হক শারেক, বিএনপি নেতা ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল বশর আজিজী, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী, জাতীয় পার্টির নেতা তাহা ইয়াহিয়া।
অন্যান্য দলে একক প্রার্থী মাঠে থাকলেও বিএনপির মধ্যে তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থী সক্রিয় রয়েছেন। এর মধ্যে সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় রাজনীতিক হিসেবে অনেক এগিয়ে আছেন। জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সংসদ নির্বাচনে নতুন হলেও স্বৈরাচার আমলে ব্যাপক নির্যাতিত হওয়ায় তার পরিচিতি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে।
অন্যদিকে, জামায়াত থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারীও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে নেই, পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন গণসংযোগ। তিনি টানা চারবার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
বাকি প্রার্থীদের মধ্যে এবি পার্টির সাংবাদিক শামশুল হক শারেক ও পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের টানা ৩ বারের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী ব্যতীত অন্যদের তেমন স্থানীয় পরিচিতি ও আলোচনা চোখে পড়ছে না। তবে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সভাপতি নুরুল বশর আজিজী এবং বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন মাঠে হালকা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মতো করে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির তাহা ইয়াহিয়া কার্যত মাঠে নেই।
ভোটারদের দাবি, যে প্রার্থী উখিয়া-টেকনাফের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবেন এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তিনিই হবেন আগামী দিনের জনঅভিভাবক। কক্সবাজার-৪ আসনটি ‘লক্ষ্মী আসন’ নামে পরিচিত। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, সেই দলই সরকার গঠন করেছে।
এ আসনে স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১২টি নির্বাচনের চিত্রে দেখা যায়; ৭ মার্চ, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধ্যাপক মফিদুল আলমকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ২য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধ্যক্ষ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীকে পরাজিত করে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী।
৭ মে, ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত ৩য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শমশের আলম চৌধুরীকে পরাজিত করে জাতীয় পার্টির আ হ আ গফুর চৌধুরী (গফুর মিয়া)।
৩ মার্চ, ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ হ আ গফুর চৌধুরী (গফুর মিয়া) কে পরাজিত করে জাতীয় পাটি সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল গনি।
২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে পরাজিত করে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবদুর রহমান বদিকে পরাজিত করে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী।
১২ জুন, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।
১ অক্টোবর, ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে পরাজিত করে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী।
২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের আবদুর রহমান বদি।
৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাহা ইয়াহিয়াকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের আবদুর রহমান বদি।
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের শাহীন আক্তার এবং ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নুরুল বশরকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের শাহীন আক্তার নির্বাচন হন এবং বিজয় লাভ করেন।
এই আসনে সর্বাধিক চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি নেতা শাহজাহান চৌধুরী। তিনি একবার ইউপি চেয়ারম্যান, একবার জাতীয় সংসদের হুইপ এবং একাধিক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আটবার সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হয়ে চারবার জয়ী ও চারবার পরাজিত হয়েছেন।
সচেতন ভোটারদের ধারণা, এবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই আসনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জামায়াত যদি অন্য দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়, তাহলে উখিয়া-টেকনাফ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবং সব হিসাব নিকাশ উল্টে যাওয়ারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে।