
ইংরেজ শাসনামলে নীলচাষিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে আজও সেই শোষণের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। জীর্ণশীর্ণ ইটের দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নারীদের সম্ভ্রম হারানোর আর্তনাদ আর কৃষকদের ওপর শোষণ-নিপীড়নের হৃদয়বিদারক ইতিহাস।
ইংরেজদের নীলকুঠি মূলত সাহেবদের বাড়ি ছিল, যেখানে তারা নীলচাষ পরিচালনা করত এবং চাষিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাত। এসব কুঠি হয়ে উঠেছিল শোষণ ও নিপীড়নের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব ধ্বংসাবশেষ দেখতে আজও ভিড় করেন পর্যটকরা, আর ঘৃণা নিয়ে স্মরণ করেন ঔপনিবেশিক শাসনের কথা।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের চৌদার (সাহেবের গাঁও) এলাকায় রয়েছে নীলকরদের বাড়ি এবং টান সিদলা গ্রামে নীলকুঠির কার্যালয় ও পুরোনো পুকুর। এসব ধ্বংসাবশেষ আজও নীলচাষের ভয়াল অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
জানা যায়, বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নামানুসারে হোসেনপুর পরগনার ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরে এই নীলকুঠি গড়ে ওঠে। আনুমানিক ১৭৩০ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নীল আবাদ শুরু করে এবং এখান থেকে প্রচুর নীল রপ্তানি হতো।
প্রথম দিকে ইংরেজরা নীলচাষে লাভবান হলেও পরে ব্যবসায় ধস নামে। নীলকর ওয়াইজ স্টিফেন্স ছিলেন এর প্রধান ব্যবসায়ী। প্রাচীন ঢাকার আরমানিটোলার আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান আরাতুন ও তার পরিবার-পরিজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ সময় কৃষকদের জোর করে নীল আবাদে বাধ্য করা হতো।
স্থানীয়দের মতে, ফ্রান্সের মাইকেল প্যাটেল চৌদার এলাকায় কারুকার্যময় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। জমিদার আমলে এলিজাবেথ হেনসন এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বাড়িটি কিশোরগঞ্জের সাবেক সমবায় কর্মকর্তা মরহুম উম্মেদ আলী ক্রয় করেন। বর্তমানে এটি আমেনা মঞ্জিল নামে পরিচিত, যা দর্শনার্থী, ইউটিউবার ও ব্লগারদের আকর্ষণীয় স্থান।
সরেজমিনে দেখা যায়, টান সিদলা বাবুর বাজার এলাকায় নীলকুঠির কার্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ এবং তার পূর্বদিকে সে সময়ের খনন করা একটি বড় পুকুর রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট মোকাবিলায় নীলচাষের সুবিধার্থে এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। আজও এলাকাটি নীলকুঠি নামেই পরিচিত।
হোসেনপুরের সিদলা, পিতলগঞ্জ, হারেঞ্জা, চৌদার, রানী খামার ও সাহেবেরচর এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে নীলকর, ইংরেজ পাদ্রী ও খ্রিস্টান জমিদারদের নানা কিংবদন্তি কাহিনি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিম মাখন বলেন, উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের কালো অধ্যায় হলো নীলচাষ। কৃষকদের দিয়ে অলাভজনক আবাদে বাধ্য করা হতো। সামান্য অবাধ্য হলেই চাষিদের ওপর চলত নির্যাতন। নীলকুঠি ছিল তাদের টর্চার সেল।