
স্বাভাবিকভাবে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে আমাদের শীতকালীন সবজি ফসল ওঠানো হয়। কিন্তু ওই সময় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না। অপরদিকে বর্ষার শেষে বাজারে সবজির যে অপর্যাপ্ততা তৈরি হয়, দামও থাকে বেশি, চাহিদাও থাকে বেশি। এসব কিছু মাথায় রেখে বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আগাম সবজি চাষে জোর দিচ্ছি ঈশ্বরদীর চাষীরা।
দেশের সবজির ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত পাবনার ঈশ্বরদীতে শীতকালীন সবজির ব্যাপক চাষ হয়। এখনো শীত মৌসুম শুরু না হলেও এখানকার চাষীরা শীতের সবজি বাজারে উঠাচ্ছেন এবং উপজেলার উঁচু জমিগুলোতে শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা রোপণ ও পরিচর্যায় সবজি চাষের পরিবারগুলো ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীতকালীন আগাম সবজি চাষ করে চাষিরা লাভবান হচ্ছেন এবং মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। যদিও এ বছর গত আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস লাগাতার বৃষ্টির কারণে সবজি ফসল উৎপাদনে কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ভালো দাম পাওয়ায় তারা খুশি এবং শীতের আগেই যাতে শীতকালীন সবজি ভোক্তাদের নিকটে পৌঁছানো যায় সেই প্রোচেষ্টায় ব্যস্ত চাষিরা। এতে চাষিরা প্রতিবছরই ভালো লাভবান হচ্ছেন। ’সবজির আগাম চাহিদা মাথায় রেখে ফলানো হচ্ছে নানান জাতের সবজি।
সোমবার( ৮ সেপ্টেম্বর ) সরেজমিনে ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন আগাম সবজি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে,সেখানে ঈশ্বরদীর সাড়া ইউনিয়নের গোপালপুর আসনা এলাকার উত্তরদিকের উঁচু মাঠে, সাহাপুর ইউনিয়নের আওতাপাড়া,চরগড়গড়ি, গড়গড়ি, আলহাজ্ব মোড়, ছলিপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর বরইচরা, ভাড়ইমাড়ি ও মুলাডুলি ইউনিয়নের বতবাড়িয়া, বাঘহাচলা, মুলাডুলি, সরইকান্দি বিশাল এলাকাজুড়ে কোথাও আবাদ হচ্ছে শিম, কোথাও মুলা ফুলকপির গাজর,কোথাও ফুলকপি বাঁধাকপি বেগুন করলা, কাঁকরোল,লাউ,লালশাক, ধনিয়া পাতা ইত্যাদি আগাম শীতকালীন সবজি আবাদ হচ্ছে।
মুলাডুলি ইউনিয়নের বাঘহাসলা গ্রামের নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো সবজি যদি মৌসুমের শুরুতে বাজারে তোলা যায়, তবে তার দাম বেশি পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে আগাম জাতের অটো শিম মুলা, লালশাক, পুঁইশাক,করলা, পালংশাক বাজারে আসতে শুরু করেছে। পর্যাপ্ত দামও পাচ্ছি।’
ঈশ্বরদীতে ভাল দাম পাওয়ার আশায় আগাম শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চাষিরা। উপজেলায় বিভিন্ন মাঠে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি। বাজারেও উঠেছে আগাম শীতকালীন সবজি। তবে দাম অনেক চড়া।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসে জানা গেছে, চলতি খরিপ মৌসুমে উপজেলায় ৫ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ অজিত হয়েছে। আগাম জাতের সবজির আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে।বর্তমানে মুলাডুলি ইউনিয়ন এর বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় আগাম জাতের শীতকালীন সবজি অটো সিম আবাদ হয়েছে ৯১০ হেক্টর জমিতে। এছাড়াও সাড়া, সাহাপুর, সলিমপুর,লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নের আওতাপাড়া, ভাড়ইমাড়ি চরকুরুলিয়া,কামালপুর এলাকায় ৩০০ হেক্টর জমিতে ফুলকপি, ৩১০ হেক্টর জমিতে গাজর সহ আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে।
গত ২৫ বছর ধরে সবজির আবাদ করছেন গোপালপুর উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুল গাফফার মল্লিক। সবজি আবাদের মাঠে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, ৮ বিঘা জমিতে মুলার আবাদ করেছিলেন। ৬ বিঘা জমির মুলা বিক্রি করেছেন। এখনো দুই বিঘা জমিতে মুলা রয়েছে। মুলা উঠানোর জমিগুলিতে গাজর বোনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, এক বিঘা জমি মুলা আবাদ করতে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। এবার তিনি বিঘা প্রতি মুলা বিক্রি করেছেন ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা। আগাম মুলা বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন তিনি। মাঠ ঘুরে দেখা যায় মোহাম্মদ আলী এসকেন, তোরাপ আলী বিশ্বাসসহ অনেক চাষির জমিতেই সবজি চাষ হচ্ছে। স্থানীয় আড়মবাড়িয়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল আলীম জানান, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া এ ধরনের ফসল উৎপাদনের উপযোগী হওয়ায় চাষীরা আগাম জাতের সবজি করে লাভের অঙ্ক গুনছেন।
আওতাপাড়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুজন ইসলাম ও স্থানীয় সবজি চাষীরা জানান, আগাম আবাদকৃত মুলা, ফুলকপি,ধনিয়ার এক চালান বিক্রি করেছেন তারা। বর্তমানে চাষিরা একটু অপেক্ষা করছেন আবহাওয়া (বৃষ্টি )দেখে পরবর্তী চালানের সবজি গাজর, শসা, করলা আবাদ করবেন। স্থানীয় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা জানান, অনেক জমি আছে যাদের (বেশি জমির ) সেইসব মালিকদের নিকট থেকে জমি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করেন তারা। চলতি মৌসুমে হঠাৎ করেই জমির মালিকরা জমির ইজারা চুক্তির মূল্য বাড়িয়ে দেওয়াই তারা পড়েছেন বিপাকে। রাস্তার পাশের যে জমির ইজারা মূল্য বিশ হাজার টাকা ছিল তা বর্তমানে ইজারা মূল্য বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা চাচ্ছেন। জমির মালিকরা যদি একটু সহনশীল হতো তাহলে তারা সবজি চাষ করে লাভবান হতেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল মুমিন বলেন, অন্যান্য ফসলের চাইতে আগাম সবজি চাষ লাভজনক। যেকোনো সবজি যদি মৌসুমের আগে বাজারে তোলা যায়, তবে তার দাম বেশি পাওয়া যায়। বিষয়টি বুঝতে পেরে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে অনেক চাষি আগাম সবজি চাষে ঝুঁকছেন। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ ও রোগবালাই দূর করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।