
দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন পাবনা ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লির তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা। শত বছরের ঐতিহ্য হস্তশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এ বেনারসি পল্লির শাড়ির সুনাম রয়েছে দেশ ও বিদেশে।
দেশি প্রযুক্তি হ্যান্ডলুমের মাধ্যমে দক্ষ শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি হয়ে থাকে এই পল্লির প্রতিটি শাড়ি। এখনো হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ির চাহিদা রয়েছে সারা দেশে।
তাই তো পূজা, ঈদ, বিয়ে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে বেনারসির শাড়ির বিকল্প নেই অনেকের কাছে। ঈশ্বরদী পৌর এলাকার ফতেমোহাম্মদপুরে দীর্ঘকাল থেকে বেনারসির তাঁত শিল্প রয়েছে। ঈশ্বরদীর কারিগরদের তৈরি বেনারসি শাড়ি বেশ আগে থেকেই দেশজুড়ে জনপ্রিয়। তাই শহরের ফতেমোহাম্মদপুর এলাকায় বেনারসি তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে রাস্তার দুই ধারে অনেক বেনারসি শাড়ি বিক্রির দোকান তৈরি হয়েছে।
এবার শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা ও ভারতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ঈশ্বরদীর বেনারসি কাতানের। তবে আগের চেয়ে তাঁত ও শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। ঈশ্বরদীর বেনারসির ব্যাপক চাহিদা থাকায় বেনারসি কারিগররা দিনরাত কাপড় বুনে যাচ্ছেন। বেনারসির পাশাপাশি তারা জরি ও পুঁতির শাড়ি তৈরি করছেন।
শাড়ি কিনতে আসা সুস্মিতা রায়, মালতী কর্মকার, পূজা রায়, মালতী রানী ও লক্ষ্মী চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, নতুন মডেলের অনেক শাড়ি বাজারে এসেছে। গতবারের চেয়ে এবার শাড়ির দাম একটু চড়া। উৎসব বলে কথা। দাম বেশি হলেও উৎসবের কারণে চড়া দামেই আমাদের শাড়ি কিনতে হচ্ছে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব বেনারসি শ্রমিক আবেদ আলী খান বলেন, এটা বাপ-দাদার পেশা। অন্য কোনো কাজ কখনো শিখিনি। তাই বেনারসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। এই পেশায় আগের মতো তেমন কাজ নেই। আমরা কিছু মানুষ এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছি। বেনারসি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে।
ফারুক বেনারসি বলেন, ঈশ্বরদীতে কয়েক শত বেনারসি শাড়ি তৈরির তাঁত ছিল। আগের চেয়ে বর্তমানে শ্রমিকের মূল্য বেড়েছে। একই সঙ্গে শাড়ি তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত সুতা, জরি ও পুঁতির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেনারসি শ্রমিকেরা অনেকেই তাদের পেশা বদল করেছেন। এখন যারা আছেন তারা অনেক কষ্টে এই পেশাটাকে ধরে রেখেছেন।
জাবেদ বেনারসি জানান, ঈশ্বরদীতে আগের চেয়ে তাঁতের সংখ্যা কমেছে। উৎপাদনের দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। শ্রমিক থেকে শুরু করে সব কিছুরই দাম বেড়েছে। আমাদের ঈশ্বরদীতে তৈরি বেনারসি কাতান রাজধানী ঢাকাসহ ভারতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পূজা উপলক্ষে সকলেই যেন শাড়ি কিনতে পারেন, ধনী, গরিব ও মধ্যবিত্তদের কথা মাথায় রেখে এবার নতুন নতুন মডেলের শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এবার পূজা উপলক্ষে অনেকেই ঈশ্বরদী থেকে বেনারসি শাড়ি কিনে তাদের ভারতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির তাঁত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওকিল বলেন, আমরা শেষ হয়ে গেছি। দেশি বেনারসি শাড়ির জন্য ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির বেশ সুনাম সারাদেশে। এখানকার হাতে তৈরি শাড়ি নিয়ে গিয়ে ভারতের শাড়ি বলে বাজারে অভিজাত শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। আবার ভারতে মেশিনে তৈরি কম দামের মানহীন শাড়িকে বেনারসি বলে ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে। তাই তো একটি চক্র কৌশলে দেশি বেনারসি শাড়ির বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
ঈশ্বরদী ফতেমোহাম্মদপুরের স্থায়ী বাসিন্দা ও পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর কামাল আশরাফী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বেনারসি তৈরির তাঁত ছিল। শাড়ি তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাঁত বন্ধের কারণে শ্রমিকেরা পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। নতুন করে কেউ এই পেশায় আসছে না। ঈশ্বরদীর বেনারসি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সহযোগিতা পেলে এই শিল্প টিকে থাকবে, নতুবা এক সময় হারিয়ে যাবে।