ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রামুর বাঁকখালী নদীতে ‘জাহাজ ভাসানো উৎসবে’ সম্প্রীতির সম্মিলন

দেশের উন্নয়নের জন্য সম্প্রীতি অপরিহার্য: ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

দেশের উন্নয়নের জন্য সম্প্রীতি অপরিহার্য: ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, কোনো দুষ্টচক্র যাতে আমাদের ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যের যে ঐতিহ্য রয়েছে, এটাকে আমরা লালন করি। আগামীতেও এটা আমরা লালন করতে থাকবো। আমরা সবাই মিলে এ দেশকে শান্তির নিবাস হিসেবে গড়ে তুলি।

মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিল সাড়ে ৫টায় রামুর বাঁকখালী নদীতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জাহাজ ভাসা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন তিনি।

ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, সম্প্রীতিতেই শান্তি। যে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই, সেই দেশের উন্নতি হতে পারেনা। দেশের স্থিতিশীলতা আসেনা। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও উৎপাদন হতে পারে না। দেশের উন্নয়নের জন্য সম্প্রীতি অপরিহার্য।

মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কল্পজাহাজ ভাসানো উৎসব। অপূর্ব কারুকাজের একেকটি দৃষ্টিনন্দন কল্পজাহাজ কয়েকটি নৌকায় একত্রে বসিয়ে ভাসানো হয় নদীতে। শতশত প্রাণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে কল্প জাহাজগুলো ঘুরে বেড়ায় নদীর এপার থেকে ওপারে। বৌদ্ধ নারীপুরুষ সহ উৎসবে-আনন্দে মেতেছে নদীর দুইপাড়ের সকল ধর্মের মানুষ। এ উৎসব বিকেলে হাজারো দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে সম্প্রীতির সম্মিলনে পরিণত হয়। বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে যুগ যুগ ধরে বাঁকখালী নদীতে কল্পজাহাজ ভাসানোর উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে। এবার ভাসানো হয় সাতটি কল্পজাহাজ। গান-বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজে বিহার ও জাদি এবং হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, হাঁস, ড্রাগন, বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব কল্পজাহাজে। চমৎকার নির্মাণ শৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই যেন নিজস্ব স্বকীয়তার ভরপুর। ভাসমান এসব কল্পজাহাজে চলছে বৌদ্ধ কীর্তন। কেউ নাচছে, কেউ গাইছে আবার কেউ ঢোল, কাঁসাসহ নানা বাদ্য বাজাচ্ছে।

'সম্প্রীতির জাহাজে, ফানুসের আলোয় দূর হোক সাম্প্রদায়িক অন্ধকার' স্লোগানে রামুর বাঁকখালী নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাজ ভাসানো উৎসব। এ উৎসবে রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের হাজারীকুল, উত্তর শ্রীকুল, দ্বীপ শ্রীকুল, মধ্যম মেরংলোয়া বড়ুয়া পাড়া, পূর্ব মেরংলোয়া, হাইটুপি বৌদ্ধ গ্রাম থেকে এবং রাজারকুল ইউনিয়নের পূর্ব রাজারকুল বড়ুয়া পাড়া থেকে সাত কল্পজাহাজ অংশগ্রহণ করেছে বলে জানান, রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক উচ্ছ্বাস বড়ুয়া।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষ পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত তৎকালীন রাখাইন এবং মঘ সম্প্রদায় রামুর বাঁকখালী নদীতে কল্পজাহাজ ভাসানো উৎসব উদ্‌যাপন করতেন। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে তাদের আধিক্য কমতে শুরু করলে বড়ুয়া বৌদ্ধরা এর হাল ধরেন। এই উৎসব সর্বপ্রথম প্রবর্তন হয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে। প্রায় দুইশত বছর আগে মিয়ানমারের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান নামক একজন ব্যক্তি এই উৎসবের সূচনা করেন।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরও বলেন, বুদ্ধের সময়কালে সমৃদ্ধিশালী বৈশালী রাজ্যে হঠাৎ দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অমনুষ্যের উপদ্রব সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছিল। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বৈশালীর রাজা বুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধকে বৈশালী রাজ্যে গমনের জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বুদ্ধ পাঁচশত জন অরহৎ ভিক্ষু নিয়ে রাজগৃহ থেকে গঙ্গা নদী হয়ে বৈশালী রাজ্যে গিয়েছিলেন। মগধরাজ বিম্বিসার স্বয়ং নৌকা সুসজ্জিত করে তার উপর বুদ্ধের জন্য সর্বরত্নময় আসন প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ সশিষ্য বৈশালীতে পৌঁছে সেখানকার উপদ্রব দূর করেছিলেন। পুনরায় গঙ্গা নদী বেয়ে মগধরাজ্যে ফিরেছিলেন। ফেরার পথে দেব, ব্রহ্মা এবং নাগরাজাও বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। সেই এক অনন্য অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সেদিনটা ছিল প্রবারণা পূর্ণিমার দিন। এই স্মৃতিকে লালন করার জন্যই বৌদ্ধরা কল্প জাহাজ ভাসিয়ে দিনটি উদ্‌যাপন করেন।

কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসবে আগত কলেজছাত্রী প্রেরণা বড়ুয়া স্বস্তি বলেন, এটি আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসব মূলত বৌদ্ধদের হলেও প্রতি বছর এটি অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলায় পরিণত হয়।

রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের আহ্বায়ক ও অনুষ্ঠানের সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথাম বলেন, বৌদ্ধদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা। যা আশ্বিনী পূর্ণিমায় পালিত হয়। ভিক্ষু সংঘের মাধ্যমে নিজেদের দোষত্রুটি প্রকাশ করে প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং বিনয়াচার ও আদর্শ জীবনযাপন করা। বিশুদ্ধ জীবন পরিচালনায় ব্রতী হওয়া এবং অন্যায় ও ধর্মাচার-পরিপন্থি কাজ পরিহার করার প্রতীক হিসেবে আমরা বৌদ্ধরা প্রবারণা উৎসব উদ্‌যাপন করি। এ উপলক্ষ্যে প্রবারণার পূর্ণিমার পরদিন বাঁকখালী নদীতে প্রতিবছর জাহাজ ভাসানো উৎসব উদ্‌যাপন করি। এটি শুধুমাত্র বৌদ্ধদের উৎসব নয়। সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সম্মিলনের উৎসব।

অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান, পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দীন শাহিন, সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক সাথি উদয় কুসুম বড়ুয়া বক্তৃতা করেন।

উন্নয়ন,সম্প্রীতি,খালিদ হোসেন
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত