ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পাবনার বিলাঞ্চলে নির্বিচারে শামুক নিধন, বিপর্যয়ের মুখে জীববৈচিত্র্য

পাবনার বিলাঞ্চলে নির্বিচারে শামুক নিধন, বিপর্যয়ের মুখে জীববৈচিত্র্য

পাবনার বিভিন্ন খাল-বিল থেকে বর্ষার পানি নামতে না নামতেই নির্বিচারে শামুক নিধন শুরু হয়েছে। মাছ ও হাঁসের খামারে খাবার চাহিদা মেটানোর জন্য বাণিজ্যিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের উৎস হিসেবে শামুক নিধন করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

জানা গেছে, হাঁস বা মাছের খামারে শামুকের চাহিদা ব্যাপক। ফলে খাল-বিল থেকে বর্ষার পানি নেমে গেলে বিল পাড়ের বাসিন্দারা নিজেদের হাঁস বা মাছের খামারে চাহিদা মেটানোর জন্য শুরুতে শামুক শিকার করলেও এখন সেটি তাদের আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে। অবাধে শামুক শিকার ও বেচাকেনা চলছে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত শামুক শিকার হয়। পাবনার চাটমোহর উপজেলার চলনবিল, সাঁথিয়া উপজেলার মুক্তার বিল, সোনই বিল, বিল গাংভাঙ্গা, গজারিয়া, আড়িয়াদাহ বিল, বাসটিয়াখালি, বেড়া উপজেলার জোরদহ বিল, কাজলকুড়া, ধলাই, ট্যাংরাগাড়ি, বক্কারের বিলসহ অন্তত ১০-১৫টি খাল ও বিল থেকে হাজার হাজার মণ শামুক শিকার হচ্ছে। পরে সেগুলো সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন হাঁস ও মাছের খামারে। এমনকি পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব শামুক কিনে ট্রাকে করে খুলনাসহ বেশকিছু অঞ্চলে সরবরাহ করেন। এতে করে খাল-বিলে কমেছে শামুকের পরিমাণ।

নাম না প্রকাশের শর্তে শামুক শিকারিরা জানান, বর্ষা মৌসুমে বিলপাড়ের অনেক বাসিন্দাদের হাতে কাজ কম থাকে। ফলে বাড়তি আয়ের জন্য বিল পাড়ের নারী-পুরুষ এ কাজ করেন। প্রতিদিন নৌকা নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মই জাল, হেসি জাল ও হাত দিয়ে শামুক সংগ্রহ করা হয়। পরে এসব শামুক পাইকারদের কাছে ৫-৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। সাঁথিয়া উপজেলার করমজা ইউনিয়নের শামুকজানি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বিল থেকে নারী ও পুরুষরা শামুক সংগ্রহ করে এনে প্রতিকেজি ৫-৭ টাকা দরে বিক্রি করছেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাঁস ও মাছের খামারিদের কাছে বিক্রি করছেন ৮-১০ টাকা কেজি দরে।

শামুকজানি গ্রামের আলতাফ হোসেন বলেন, ‘পানি কম থাকলে হাত দিয়ে শামুক ধরা যায়। এছাড়া জাল দিয়েও ধরা হয়। প্রতিকেজি শামুক ৫-৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। কাজ না থাকার এই সময়ে টুকটাক বাজার-সদাই তো চলে।’ সাঁথিয়ার আফড়া গ্রামের রশিদ ও নাহিদা বলেন, ‘আইন কানুন কী আছে জানি না। কেউ কখনো বলেও নাই। এই সময় কাজ-কাম কম থাকে। এ কারণে সংসারে টানাটানি থাকে। তাই নৌকা নিয়ে আবার কখনো নৌকা ছাড়াই শামুক ধরি। পরে সেগুলো বস্তায় ভরে পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করি। গড়ে ৪০০-৫০০ টাকা ইনকাম করা যায়।’

শামুক ব্যবসায়ী আজমত শেখ জানান, বর্ষাকালে এসব এলাকায় প্রচুর শামুক পাওয়া যায়। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ বস্তা শামুক বেচাকেনা হয়। তবে সাঁথিয়ার অন্যান্য জায়গায় আরও বেশি বেচাকেনা হয়। বিলপাড়ের মানুষেরা বিভিন্ন আকারের শামুক শিকার করে আমাদের কাছে আনেন। আমরা এগুলো ক্রয় করে অল্প লাভে খুলনায় সরবরাহ করি।

এগুলো বেচাকেনা অপরাধ। তবুও এগুলো কেন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকার জন্য ব্যবসা করি। আইনে এসব নিষিদ্ধ কি-না কিছুই জানি না।’

এদিকে অপরিকল্পিতভাবে এসব খাল-বিলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নিধনের ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, ‘শামুক মাটিতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। কৃষি উৎপাদন বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্বিচারে অতিরিক্ত হারে শামুক নিধন উচিত নয়। এটি সরাসরি ফসলে প্রভাব না ফেললেও জীববৈচিত্র্যের ওপর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।’

পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল বলেন, জীববৈচিত্র্যের প্রত্যেকটি বিভাগের সাথে অন্য বিভাগের সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে শামুকের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণীর পাশাপাশি মৎস্য বা মাছেরও সম্পর্ক রয়েছে। শামুকের ছোট ডিম ও বাচ্চাগুলো খেয়ে কিছু মাছ বেঁচে থাকে। এছাড়া শামুক নিচের ময়লা খেয়ে পানি পরিষ্কার রাখে। এটি শুধু মাছ নয় অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্যও ইতিবাচক বিষয়। শামুক মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

তিনি বলেন, বিল বা খালে শামুক প্রয়োজনীয় হারের তুলনায় কম হয়ে গেলে সেটি মাছ বা জলজ অন্যান্য প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর বিষয় হবে। অবাধে শামুক শিকার রোধের বিষয়টি আমাদের দেখার তেমন সুযোগ নেই। ফলে আমরা তেমন পদক্ষেপ নিতে পারি না। তবে বিনা বিবেচনায় শামুক শিকার করে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

উল্লেখ্য, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী শামুক সংগ্রহ, ধ্বংস, ভক্ষণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

এ ব্যাপারে রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর জানান, শামুককে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক জলশোধন ব্যবস্থা’ (ফিল্টার)। শামুক ময়লাযুক্ত পানি পান করে জীবনধারণ করে। ফলে পানি পরিষ্কার থাকে। পানিতে শামুক না থাকলে পানির প্রাকৃতিক শোধন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তিনি বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অতি জরুরি দাবি করেন।

পাবনা,বিলাঞ্চল,শামুক নিধন,জীববৈচিত্র্য
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত