ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নাটুদার জমিদার বাড়ির শেষ নিদর্শন সিংহ দুয়ার, অবহেলায় বিলুপ্তির পথে

নাটুদার জমিদার বাড়ির শেষ নিদর্শন সিংহ দুয়ার, অবহেলায় বিলুপ্তির পথে

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত সকল কীর্তিই আজ ধ্বংসের পথে। আজ আর নেই সেই জমিদার মহলের খাজনা আদায়ের লাঠিয়াল বাহিনী, নেই জমিদার মহলের নর্তকীর নাচের ঝলকানি, নেই কোনো পাইক পেয়াদা, বরকন্দাজ, চাকর-বাকর, ঘোড়াশাল আর সুবিশাল অট্টালিকা। কালের বিবর্তনে প্রায় সবকিছুই আজ ধ্বংসের পথে। অধিকাংশ কীর্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও স্মৃতি চিহ্ন বহন করে চলেছে দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদা অঞ্চলের জমিদার নফর পাল চৌধুরীর জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে স্থাপিত দুটি মন্দির বা প্রধান ফটক।

১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড কর্নওয়ালিস ভূমি ব্যবস্থাপনায় ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রথা চালু করেন। সেই সময় ভারতের ২৪ পরগনার প্রভাবশালী ব্যক্তি শ্রী মধুসূদন চন্দ্র পালের একমাত্র পুত্র নফর চন্দ্র পাল চৌধুরী চুয়াডাঙ্গার নাটুদা, কার্পাসডাঙ্গা, মেমনগর, বাগোয়ান ও মেদনীপুর এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি নাটুদা অঞ্চলকে ‘সদর স্ট্রেট’ ঘোষণা করে জমিদারি প্রথা চালু করেন।

নফর চন্দ্র পাল ছিলেন জনদরদী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। হিন্দুপ্রধান এই এলাকায় মুসলমান প্রজা কম থাকলেও তিনি সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। গরিব প্রজাদের জন্য তিনি খাজনা মওকুফ করতেন এবং দান করতেন আর্থিক অনুদান। তাঁর স্ত্রী রাধারাণী দেবীও ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও মানবপ্রেমী।

প্রজাদের শিক্ষায় উৎসাহ দিতে জমিদার ভবনের উত্তর পাশে একটি খড়–কাঠের প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন নফর চন্দ্র পাল। স্ত্রী রাধারাণীর অনুরোধে প্রথমদিকে বিদ্যালয়ে টিফিন ব্যবস্থা চালু করেন, যা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ায়। পরে ১৯০৬ সালে স্ত্রীর নামে ‘রাধারাণী ইনস্টিটিউট’ নামে একটি বড় আকারের পাকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। কলকাতা থেকে শিক্ষিত শ্রী নরেন্দ্র নাথ সিংহকে এনে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বর্তমানে এটি ‘নাটুদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত।

চারতলা বিশিষ্ট এল-আকৃতির সুবিশাল জমিদার ভবনটি ছিল একটি সুরক্ষিত প্রাসাদ। সামনে ছিল সিংহচিহ্ন সম্বলিত সুদৃশ্য প্রধান ফটক। ফটকের পাশে ছিল দুটি মন্দির, একটি পুকুর, আমবাগান, স্নানঘর, ঘোড়ার গোসলের পুকুর, পোস্ট অফিস ও বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারখানা। জমিদার পরিবার এই স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।

জমিদার পরিবারের উত্তরাধিকার ও হাওয়া ভবন

নফর চন্দ্র পালের ছোট ছেলে ক্ষিতিশ চন্দ্র পাল উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যান এবং টেমস নদীর তীরের একটি অট্টালিকা দেখে অনুরূপ একটি ভবন নির্মাণের অনুরোধ করেন। পিতা নাটুদা ও বোয়ালমারীর মাঝামাঝি ভৈরব নদীর তীরে সেই অনুরূপ ‘হাওয়া ভবন’ নির্মাণ করেন। ভবনটির সামনের ফুলের বাগানে দোলনচাঁপা, কামিনী আর হাস্নাহেনার গন্ধে মুখরিত হতো পরিবেশ।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও ব্রিটিশ শাসনের অবসানে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে। নাটুদা সদরসহ জমিদার বাড়ির প্রায় সবকিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। তবুও জমিদার নফর চন্দ্র পাল চৌধুরীর সেই স্মৃতিবিজড়িত ‘সিংহ দুয়ার’ আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের নীরব প্রহরী হয়ে।

এলাকাবাসীর দাবি—আগামী নতুন প্রজন্ম যেন এ অঞ্চলের জমিদারি ইতিহাস জানতে পারে, সেই শেষ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

অবহেলায় বিলুপ্তির পথে,নিদর্শন সিংহ দুয়ার,নাটুদার জমিদার বাড়ি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত