ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মালিঝিকান্দার ঐতিহাসিক বধ্যভূমি আঁকড়ে ধরেছে পরগাছায়

মালিঝিকান্দার ঐতিহাসিক বধ্যভূমি আঁকড়ে ধরেছে পরগাছায়

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই স্মৃতিতে জেগে ওঠে মহান স্বাধীনতার নানা স্মৃতি। খুঁজে ফিরি যুদ্ধে হতাহত মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতিস্থান, স্মৃতিস্তম্ভ, বধ্যভূমি, শহীদস্তম্ভ ইত্যাদি। অথচ বছরের এগারো মাসই আমরা এসব স্মৃতিচিহ্ন বেমালুম ভুলে থাকি। তেমনই একটি স্মৃতিস্তম্ভ—শেরপুরের মালিঝিকান্দার ঐতিহাসিক গণকবর ও বধ্যভূমি—আজ আমাদের স্মৃতির আড়ালে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

শেরপুর-ঝিনাইগাতী সড়ক সংলগ্ন ঝিনাইগাতী উপজেলার মালিঝিকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন থেকে পশ্চিমে প্রায় ৫০০ মিটার কাঁচা রাস্তা পেরোলেই বাঁশঝাড়ের নিচে দেখা মেলে একটি পাকা স্থাপনা। কেউ দেখিয়ে না দিলে বোঝার উপায় নেই—এই বাঁশঝাড়ের ভেতরেই রয়েছে শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমি। নামফলক না থাকায় স্থানীয়রা ছাড়া নতুন কেউ বুঝতেই পারবে না এ ঐতিহাসিক স্থানের অস্তিত্ব।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার সাক্ষী হয়ে অবহেলায় আর অযত্নে পড়ে আছে এই বধ্যভূমি।

সরেজমিনে দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভে শেওলা জমেছে, গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য পরগাছা। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় বেদিতে শুকানো হচ্ছে খড়ি। বেদির ওপর পড়ে আছে গোবর ও খড়। বাঁশঝাড়ে আচ্ছাদিত স্থাপনাটি স্মৃতিস্তম্ভ হলেও নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জেলার সবচেয়ে বড় এ বধ্যভূমি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর শহরের কয়ারি রোড এলাকায় জেলার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষকে ধরে এনে এখানে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। পাশেই ছিল টর্চারসেল। যুদ্ধের সময় এখান থেকেই ভেসে আসত মানুষের আর্তচিৎকার।

ক্যাম্পের ৫০০ মিটার পশ্চিমে ১০ শতাংশ জমিজুড়ে ছিল তিন ফুট গভীর গর্ত। যুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো এবং ওই গর্তেই দাফন করা হতো।

স্বাধীনতার পর গ্রামবাসী ফিরে এসে গর্তটিতে অসংখ্য লাশ দেখতে পান। পরে তারা সম্মিলিতভাবে এসব মরদেহ মাটিচাপা দেন। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত ঘরে শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে; ভারতে আশ্রয় নেওয়া মানুষ বাড়ি ফেরার পথে এখানে বিশ্রাম নিতেন।

২০০৮ সালে সেনাবাহিনী ১২ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে।

এ বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষক মো. আলমগীর হোসাইন বলেন, “আমরা শুনেছি পাকিস্তানি হানাদাররা টর্চারসেলে মানুষকে নির্যাতন করতেন। যারা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারা যেতেন, তাদের এই গর্তে ফেলে দিতেন। এখানে শত শত মানুষের লাশ পুঁতে রাখা আছে।” তিনি এই স্থানটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানান।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য মো. আকবর আলী বলেন, “এই বধ্যভূমির কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। এমনকি দেখভালের জন্য কোনো কমিটিও নেই।” তিনি বধ্যভূমি রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, “এই উপজেলার ঘাগড়া কুনাপাড়া গ্রামের স্মৃতিস্তম্ভটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। আজ পর্যন্ত এর নির্মাণকাজও শেষ হয়নি। কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় এখানে গরু-ছাগল অবাধে বিচরণ করে, শুকানো হয় গোবর। এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, “দ্রুত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বধ্যভূমির সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ সারাবছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন প্রজন্ম যেন এই বধ্যভূমির ইতিহাস জানতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করা হবে।”

আঁকড়ে ধরেছে পরগাছায়,ঐতিহাসিক বধ্যভূমি,মালিঝিকান্দা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত