অনলাইন সংস্করণ
১৩:১৩, ৩০ জুলাই, ২০২৫
জামায়াতের প্রয়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) গুম ও তাকে টিএফআই সেলে আটক রাখার বিষয়ে চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক মামলায় চলতি বছরের ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পাঁচ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে ২০১৮ এর ভোটে অনিয়ম, গুম, খুন ও জুলাই আন্দোলন নিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন তিনি। সেখানে আরমানের গুমের বিষয়েও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাবেক এই পুলিশ প্রধান।
জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন অভিযোগ করেছেন—গুম-খুন বা কাউকে গোপনে তুলে আনার মতো কর্মকাণ্ডের পেছনে সরাসরি নির্দেশনা দিতেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকি। তবে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে থাকলেও এসব কার্যক্রমের অনেক কিছুই তাকে জানানো হত না।
সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এই ধরনের আদেশ পাই নাই। কিছু কিছু নির্দেশনা নিরাপত্তা ও সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি। র্যাব যদিও পুলিশের আইজির অধীনে ছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না এবং র্যাবের প্রধানরা আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর নির্দেশে কাজ করতেন।
জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, আমি যতদিন র্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম চেষ্টা করেছি সিরিয়াস বিষয়গুলো আইজিকে অবহিত রাখতে। টিএফআই সেলে কতজন বন্দি আসতো বা কারাবন্দি আছে এসব বিষয়ে সবকিছু আমাকে জানানো হতো না। এ বিষয়গুলো র্যাবের ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) দেখভাল করতেন।
ব্যারিস্টার আরমানের গুম থাকা প্রসঙ্গে চৌধুরী মামুন বলেন, ব্যারিস্টার আরমান টিএফআই সেলে বন্দি আছে, এ বিষয়টি আমি জানতাম। তবে তাকে আমার সময় তুলে আনা হয়নি। অনেক আগে তুলে আনা হয়। আমার পূর্ববর্তী ডিজি র্যাব বেনজির আহমেদ দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ব্যারিস্টার আরমান যে টিএফআইতে আটক আছেন তা আমাকে অবহিত করেন।
পরবর্তীতে এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) ও ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) সরোয়ার বিন কাশেমও আরমানের আটকের বিষয়টি আমাকে অবহিত করেন। তাকে তুলে আনা এবং বন্দি করে রাখার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল। তাকে টিএফআই সেলে আটক ও গুম করে রাখার বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। এ বিষয়টি জানার পরে আমি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির সঙ্গে কথা বলি। তারিক সিদ্দিকি আমাকে বলেন ঠিক আছে রাখেন, বিষয়টি আপনাকে পরে বলবো। পরে তিনি আমাকে কিছুই জানায়নি। এরপরও আমি বিষয়টি কয়েকবার তারিক সিদ্দিকির কাছে উত্থাপন করি কিন্তু তিনি এ বিষয়ে আর কোনো নির্দেশনা দেননি। আমি ডিরেক্টর জেনারেল (র্যাব) হিসেবে দায়িত্বভার হস্তান্তরের সময় পরবর্তী ডিরেক্টর জেনারেল (র্যাব) খুরশিদ হোসেনকে আরমানের বিষয়টি অবহিত করি।
পুলিশের সাবেক এই আইজি জানান, আমার র্যাবের দায়িত্বপালনকালীন যারা ডিরেক্টর (ইন্টেলিজেন্স) হিসেবে কাজ করেছেন তারা হলেন- সারওয়ার বিন কাশেম, খায়রুল ইসলাম ও মশিউর রহমান। আমি র্যাবে দায়িত্বপালনকালীন টিএফআই সেলের বিনা বিচারে বন্দিদের আটক রাখা এবং নির্যাতন করা বা কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার কিছু কিছু বিষয় জানতাম কিন্তু আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য বাহিনীর এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আসতো এবং তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করতো। এমনকি পুলিশ প্রধান হয়েও আমি র্যাবের এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি বা করতে পারিনি। কারণ এ বিষয়গুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাস্তবায়ন করতো এবং কিছু কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকির কাছ থেকে নির্দেশনা আসতো। অনেক ক্ষেত্রে আমার কথাকে গুরুত্ব দিত না।
ওই জবানবন্দিতে চৌধুরী মামুন বলেন, র্যাব যে সমস্ত আভিযানিক কাজ পরিচালনা করে সেগুলো অধিকাংশ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ও পরামর্শের ভিত্তিতে করে। এ ব্যাপারে আইজিপিকে প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা হতো না।
তিনি আরও বলেন, র্যাবের আলেপ উদ্দিন এবং মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি চিনতাম। আলেপ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে র্যাবে ছিলেন, পরবর্তীতে এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) এর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে তাকে র্যাব (ইন্টেলিজেন্স) এ পদায়ন করা হয়। র্যাব (ইন্টেলিজেন্স) এ অনেক অফিসার ছিলেন। গুমসহ বিভিন্ন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আলেপের বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে র্যাবের অফিসাররা পছন্দ করতেন। কারণ তিনি এই কাজে পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে নিয়োজিত অফিসার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত র্যাবের বাকি অফিসারদের অধিকাংশই ছিল মিলিটারি অফিসার। কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো জেনারেল তারিক সিদ্দিকি সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন। এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সবকিছু অবহিত করা হতো না।