ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরি ছাড়া উপায় নেই: আলজাজিরার বিশ্লেষণ

ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরি ছাড়া উপায় নেই: আলজাজিরার বিশ্লেষণ

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিমান হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই হামলার ফলে ইরান হয়তো তার দীর্ঘদিনের পারমাণবিক নীতিতে আমূল পরিবর্তনের পথে হাঁটতে বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে বাধ্য করতে পারে।

আন্তর্জাতিক সঙ্কট বিশ্লেষণ সংস্থা আইসিজি’র ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী ভায়েজ মনে করেন, ইসরায়েলের হামলা ইরানের কৌশলগত ধৈর্যের অবসান ঘটাতে পারে। তার মতে, এখন ইরানের সামনে দুটি পথ, হয় আত্মরক্ষার জন্য পরমাণু অস্ত্র তৈরি, নয়তো বারবারের মতো আত্মসমর্পণ। একইসঙ্গে, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশটির অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক ভারসাম্য কট্টরপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে।

ইরানে দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কারপন্থী ও কট্টরপন্থীদের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে বিতর্ক চলছিল। তবে সাম্প্রতিক হামলা কট্টরপন্থীদের বক্তব্যকে আরও জোরালো করেছে। ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং-এর রেজা এইচ আকবরির মতে, পশ্চিমাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টাকে এখন অনেকেই ব্যর্থ ও অর্থহীন মনে করছেন। তাদের মতে, সামরিকভাবে দুর্বল থেকে কোনো ছাড় আশা করা ভুল হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসনের অধীনে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তিগুলোর একটি ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি হয়। এটি জাতিসংঘে অনুমোদিত হলেও ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে তা থেকে সরে যান, ফলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার চরম সংকট তৈরি হয়। তেহরান তখন সীমিতভাবে চুক্তি লঙ্ঘনের পথ ধরে, যা একপর্যায়ে আবার আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা তৈরি করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষক আকবরি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সম্মতিতে ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে এবং এর ফলে পারমাণবিক কূটনীতির পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি কট্টরপন্থীদেরই সমর্থন দিতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

একসময় আঞ্চলিক প্রতিরোধ জোটের ওপর নির্ভর করলেও বর্তমানে ইরানের সেই শক্তি অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, সংগঠনটির নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, সিরিয়াতেও বাশার আল-আসাদের সরকার পতনের পর ইরানের প্রভাব কমে গেছে। ফলে আগের মতো রসদ সরবরাহ ও আঞ্চলিক জোট গড়ে তোলার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তেহরানের।

এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান এখন আর পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসবে না। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক মাইকেল স্টিফেনস বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খামেনির সামনে হয় আপসের নির্দেশ দেওয়া, নয়তো পরবর্তী হামলার ঝুঁকি মাথায় নেওয়ার দ্বিধাবিভক্ত পথ। তার মতে, যেকোনো সিদ্ধান্তেই ইরানের জন্য ঝুঁকি রয়েছে, তবে বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে তা বাস্তবায়ন করা এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

এদিকে ইরানের কর্মকর্তারা অতীতের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থার জায়গায় রয়েছেন। সিআইপি’র বিশ্লেষক নেগার মোর্তাজাভি বলেন, গাদ্দাফির উদাহরণ ইরানের জন্য একটি সতর্কবার্তা। লিবিয়ার নেতা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করেও শেষ পর্যন্ত বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ইরান সম্ভবত পারমাণবিক কর্মসূচিকে এখন আত্মরক্ষার একমাত্র পথ হিসেবে দেখছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে যদি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকেই নয়, পুরো বিশ্বের নিরাপত্তা কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

ইরান,পারমাণবিক,বোমা,আলজাজিরা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত