ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর হরমুজ প্রণালিকে ঘিরে আবারও বৈশ্বিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে ইরান এই কৌশলগত সামুদ্রিক রুটটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে, যার প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায়। বিশেষত চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বে, যারা তেলের জন্য মূলত উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল।
হরমুজ প্রণালি ইরান ও ওমানের মাঝে অবস্থিত এবং এটি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবাহিত হয়। বিশ্বজুড়ে পরিবাহিত তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশই এই রুটের ওপর নির্ভরশীল। যদিও প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ৪০ কিলোমিটার, তবে এর মাধ্যমেই বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলারের জ্বালানি বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। এই রুটে সামান্য বিঘ্নতা বিশ্ববাজারে তেলের দামে নাটকীয় উল্লম্ফন ঘটাতে পারে এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালি ইরানের জন্য ‘কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতা’র মতো, যা তারা ধাপে ধাপে বন্ধ করতে পারে—যেমন চলাচল সীমিত করা, সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো, মাইন স্থাপন, বাণিজ্যিক জাহাজ আটকানো বা সাবমেরিন-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি দেওয়া। ইরান এর আগেও ১৯৮০–৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় এই প্রণালি ব্যবহার করে সামরিক কৌশল নিয়েছিল।
সম্প্রতি ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড হরমুজ প্রণালির কাছে তাদের নৌবাহিনীর ইউনিট পরিদর্শন করেছে। এতে ইঙ্গিত মিলেছে, হাই-স্পিড ক্ষেপণাস্ত্রবাহী নৌযান, সাবমেরিন, অ্যান্টি-শিপ মাইন ও ড্রোন দিয়ে ইরান এখানে বড় আকারের সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
ভোরটেক্সা ও ইআইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, হরমুজ প্রণালি দিয়ে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব। আর আমদানির দিক দিয়ে চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। চীন তুলনামূলক কম দামে ইরান থেকে তেল নেয়। দক্ষিণ কোরিয়ার তেলের ৬০ শতাংশই এই রুট দিয়ে আসে। ভারতও বড় অংশে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানি করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিদিন গড়ে ৭ লাখ ব্যারেল তেল নেয় এই রুট দিয়ে, যা তাদের মোট আমদানির প্রায় ১১ শতাংশ।
বিকল্প রুটের প্রসঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরান নিজস্ব পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। তবে তা হরমুজ প্রণালির বিকল্প হিসেবে পুরোপুরি কার্যকর নয়। সৌদি আরবের পূর্ব-পশ্চিম পাইপলাইনের ক্ষমতা দিনে ৫০ লাখ ব্যারেল এবং আমিরাতের ফুজাইরাহ পাইপলাইনে ১৫ লাখ ব্যারেল। ইরানের গোরেহ-জাস্ক পাইপলাইন এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হরমুজ প্রণালি সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা সামরিক উপায়ে তা পুনরায় খুলে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এর মধ্যেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠতে পারে। ফলে হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।