ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মসজিদের ভূমিকা

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মসজিদের ভূমিকা

আল্লাহর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ। এটি মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ও ইসলামের নিদর্শনাবলির অন্যতম স্থান। মসজিদে মুসলমানরা দ্বীনের মূলভিত্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। ইসলামের মূলভিত্তি আদায়ের স্থান হিসেবে দ্বীনের অন্য কার্যাবলি সম্পাদনেও মসজিদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক ও অনস্বীকার্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড মসজিদ থেকে পরিচালনা করেছেন। অথচ কালের পরিক্রমায়, বিশেষত বাংলাদেশে মসজিদ শুধু নামাজের স্থান হিসেবে বিবেচিত। মুসলমানদের চরিত্র গঠন, দীনি শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচিতে মসজিদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। মসজিদ তার অতীত গৌরবে ফিরে এলে মসজিদই হতে পারে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের পরীক্ষিত উপাদান।

মসজিদ ঈমানদারের সঙ্গী : মসজিদের সঙ্গে আছে ঈমানের সম্পর্ক। ঈমানদারই মসজিদের আবাদ করে। সে যেখানেই থাকুক, তার অন্তর মসজিদের সঙ্গে আবদ্ধ থাকে। সে নামাজের সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। সময়মতো মসজিদে গমন করে। নামাজের পর যখন মসজিদ থেকে বেরোয়, পরবর্তী নামাজের অপেক্ষায় থাকে। ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই সে স্বাচ্ছন্দ্যে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে সক্ষম হয়। মসজিদের সঙ্গে এ রকম আত্মার সম্পর্ক যাদের, হাশরের ময়দানে তাদের ঠিকানা হবে আল্লাহর আরশের সুশীতল ছায়াতলে। আল্লাহ বলেন, ‘তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনে।’ (সুরা তওবা : ১৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যেদিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। যাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সঙ্গে থাকে।’ (বোখারি : ৬২৯)।

মুসল্লিদের কল্যাণকামী : মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে মুসল্লিদের কল্যাণকামী করে তোলে। প্রতিদিনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে মসজিদে যেতে হয়। নামাজের কাতারে ধনী-গরিব, আমির-ফকির, মালিক-শ্রমিকের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। পার্থক্য থাকে না পেশা, বংশ বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও। সবাই এক কাতারে অভিন্ন মর্যাদার মানুষে পরিণত হয়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি মুসল্লিরা পারস্পরিক কুশলবিনিময় ও খোঁজখবর নেওয়ার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলে একে অন্যের কল্যাণকামী, সহযোগী ও নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে। এভাবে পারস্পরিক সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট হওয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমানে পরিণত হয়। প্রকৃত মুসলমান হলো, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমানরা নিরাপদ থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত ও মুখের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ১০)।

মসজিদভিত্তিক সমাজের বৈশিষ্ট্য : মসজিদ ইসলাম চর্চার মূলকেন্দ্র। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে মসজিদে নববি ছিল দ্বীন শিক্ষার পাঠকক্ষ। একদল গরিব সাহাবি ইলমচর্চার জন্য মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। তাদের ‘আসহাবে সুফফা’ বলা হয়। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখনিঃসৃত হাদিস সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সুযোগ পেলেই মসজিদে এসে সাহাবিদের দ্বীন শেখাতেন। মসজিদভিত্তিক দ্বীনি জ্ঞানচর্চার ধারা অব্যাহত থাকলে মানুষ খুব সহজেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। কোনো সমাজে যত বেশি ইসলামি জ্ঞানের চর্চা বাড়বে, সেই সমাজ থেকে তত বেশি অপরাধ কমে যাবে। এ ছাড়া মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের সংস্কৃতি চালু থাকলে মুসল্লিরা নামাজের পাশাপাশি কোরআন-হাদিসসহ ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধ হতে পারে। যে সমাজে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি যত জোরালো হবে, সেই সমাজ তত বেশি আদর্শ সমাজে রূপান্তরিত হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) নানাভাবে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে একমাত্র দীনের শিক্ষাগ্রহণ অথবা শিক্ষাদানের জন্য আসবে, তার মর্যাদা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণকারীর মতো হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭)। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কোনো এক ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন সেখানে দুটি মজলিস চলছিল। একটি মজলিসে লোকজন কোরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিল এবং অন্য মজলিসে লোকজন শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানে রত ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সবাই কল্যাণকর তৎপরতায় রত আছে। এ মজলিসের লোকজন কোরআন তেলাওয়াত করছে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করছে। তিনি চাইলে তাদের দান করতেও পারেন আবার চাইলে নাও দিতে পারেন। অন্যদিকে এ মজলিসের লোকেরা শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানে রত আছে। আর আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি।’ এরপর তিনি তাদের মজলিসে বসলেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৯)। তা ছাড়া ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মসজিদভিত্তিক দ্বীনি শিক্ষাকার্যক্রমকে মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণকর হিসেবে উল্লেখ করে গুরুত্ব দিয়েছেন। (হায়াতুস সাহাবা : ৪/১৭০)।

মসজিদভিত্তিক কর্মসূচি : আদর্শ সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ হওয়ার বিষয়টি মসজিদে নববি তথা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদ থেকে পাওয়া যায়। সেখানে সব ধরনের ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যস্থার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি জাতিকে সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে নামাজ-বন্দেগির পাশাপাশি মসজিদভিত্তিক দ্বীনি শিক্ষা, উচ্চতর ইসলামি গবেষণা, চিকিৎসাসেবা, সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি, ইসলামি লাইব্রেরি, শিশু-কিশোরদের জন্য ইসলামি সংস্কৃতি ও নানা ধরনের মানবিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই মসজিদের শিষ্টাচার রক্ষা এবং ইসলামি আদর্শ ও নীতিমালার আলোকে মসজিদ পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : আলেম গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আদর্শ সমাজ,মসজিদ,ভূমিকা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত